শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

জনৈক হিমুর এলোমেলো একটি দিন

 কিছু কথাঃ “হিমু” নিয়ে সবার ফ্যান্টাসিটা একটু বেশিই। আর এই ফ্যান্টাসি সৃষ্টির মূলে রয়েছেন সাহিত্যের জাদুকর “হুমায়ূন আহমেদ” স্যার। তার অনবদ্য সৃষ্টি এই “হিমু” চরিত্রটি খুব দ্রুতই সবার মন জয় করে নিয়েছে। স্যারের অকালে চলে যাওয়া আমাদের যতটা দুঃখ দিয়েছে, ঠিক ততটাই দুঃখ দিয়েছে তার সৃষ্ট “হিমু” চরিত্রটির অকালে ঝড়ে যাওয়া তে। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তাকে উৎসর্গ করে আমার এই ছোট একটি লিখা।

অফিস থেকে বাসায় ফিরবার পথে বিশ্বাসঘাতক গাড়িটা হিমাদ্রির সাথে আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করলো। একে তো কুকুর বিড়ালের মত বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, আরেকদিকে গাড়িটা ঝিম মেরে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। কোনমতে গাড়িটা লক করে, দ্বিগুণ ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি ধরে, কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরল সে। কলিংবেল টিপতেই বুয়া দরজা খুলে দিল। হিমাদ্রির ধারনা ছিল হয়তো দরজাটা রূপা-ই খুলবে। রূপা হলো হিমাদ্রির সদ্য বিবাহিত বউ, যদিও লাভ ম্যারেজ তবুও জামাই জামাই ভাবটা একটু বেশিই খাটাতে চায় হিমাদ্রি।  ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো রূপা সোফায় বসে বই পড়ছে আর জোরে জোরে হাসছে, বইয়ের নাম... “হিমু রিমান্ডে”, বইয়ের নাম দেখে তার মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে সারাটা দিন হিমু নিয়ে বসে থাকে, একই বই বারবার করে পড়ে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার জামাই যে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে, সেদিকে তার কোন নজরই নেই! সে আছে তার হিমু নিয়ে! নাম রূপা হলেই কি হিমুর জন্য এতো বেশি পাগল হতে হবে? পৃথিবীর সব রূপা-ই কি হিমুর জন্য পাগল হয়!

মাঝে মাঝে সুযোগ বোঝেই কিছু কমন কথা শোনায় রূপা, বিশেষ করে শপিঙে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে। তার মধ্যে কিছু  হল- খবরদার কোন মেয়ের দিকে তাকাবা না, কারন হিমুরা কোন মেয়ের দিকে তাকায় না। হিমুর মত হতে চেষ্টা করো, জানি কখনো পারবা না, তারপরও বলি। আর অফিসে যাওয়ার আগে প্রতিটাদিন ওর কাছ থেকে একই কথা শুনতে শুনতে হিমাদ্রি অতিষ্ঠ হয়ে গেছে- খবরদার ভুলবশতও কোন কলিগ বা অন্য কোন মেয়ের হাত স্পর্শও করবা না। হিমুরা এই কাজ কখনই করে না। একবার শপিঙে গিয়ে ভুলক্রমে হঠাৎ এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগাতেই যে কি কাহিনী ঘটে গিয়েছিল ওদের মাঝে!!! তা না হয় অব্যক্তই রয়ে যাক।

“রূপা, বৃষ্টিতে ভিজে মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। এক কাপ আদা চা বানিয়ে দাও তো।” হিমাদ্রি রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

“বুয়া, তোমার ভাইজানের জন্য এক কাপ আদা চা নিয়ে এসো।” বই থেকে চোখ না সরিয়েই কথাটা বলল রূপা।

“রূপা, আমি তোমাকে বলেছি চা বানিয়ে আনতে।”

“উফ, দেখছই তো আমি হিমু পড়ছি। ডিস্টার্ব করো না তো!”

“এসবের মানে কি? হিমু হিমু হিমু...সারাটা দিন হিমু নিয়ে পরে থাকো। আর কোনদিকে তোমার কোন খেয়াল নেই। রোজ রোজ এসব কিন্তু ভাল্লাগে না।”

এবার রূপা বই থেকে চোখ তুলে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল,  “বিয়ের আগে আমি তোমাকে বলি নাই যে আমি হিমুর কত বড় ভক্ত? বলি নাই যে আমি রাত-দিন হিমু পড়ি? বলি নাই?”

“হুম, বলেছ।”

“এসব শুনে তখন কি বলেছিলা মনে আছে?? তাহলে আমি তোমার হিমু হব, তুমি হবা আমার রূপা। আমি হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াবো, আর তুমি আমার রূপা হয়ে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করবা।”

হিমাদ্রি একদম চুপ হয়ে শুনছে সব। কারন সে কথাগুলো সত্যি এসব বলেছিল।


“কি চুপ মেরে গেলা কেন? মনে পড়ে এইসব কথা? বড় ভাইয়ার বন্ধু ছিলা বলে প্রায় তো বাসায় আসতা। আমি বই পড়তাম আর তুমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখতা। ভাইয়ার মুখে শুনলাম তোমার নাম নাকি হিমু! হিমাদ্রিকে সবাই নাকি সংক্ষেপে হিমু বলে ডাকে! তখন থেকেই তোমার প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ি, ভেবো না তোমার কারনে, কারনটা ছিল তোমার নাম। আর কত কিছুই না ভেবেছিলাম তোমার সম্পর্কে, কত আকাশ-কুসুম চিন্তাও করেছিলাম! ভেবেছিলাম তোমার মধ্যে হিমুর সব গুণাবলী বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু হায়!

যাই হোক, তখনতো পটানোর জন্য কত কথাই বলেছিলা,  কিন্তু বিয়ের পর তো আর কিছু মনে রাখার দরকার হয় না, তাই না? আসলে সবাই ঠিকই বলে, বিয়ের পর সবকিছু বদলে যায়, সব।” রূপা অফসোস মাখা কন্ঠ নিয়ে কথাগুলো বলেই হিমাদ্রির সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে যায় পাশের ঘরে। হিমাদ্রি চুপ হয়ে বসে থাকে, তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। বিয়ের আগে রূপা সত্যিই বলেছিল যে হিমু নাকি তার প্রথম ভালবাসা।


অন্ধকার কালো রাত, হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে কালো কালো মেঘের মাঝ থেকে চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। অপূর্ব এক দৃশ্য। কিন্তু আজ এই দৃশ্য হিমাদ্রিকে নাড়া দিচ্ছে না, ছাদের চিলেকোঠায় বসে আছে। বিষণ্ণতা যেন তাকে গ্রাস করে গেছে কিছু সময়ের জন্য, কিছুটা আনমনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে আজ-কালকের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি হয়ে যাবে। রূপা রাগ করে না খাওয়ায়, সেও কিচ্ছু খায় নি। রাত অনেক হয়েছে, কিছুটা ক্ষুধাও লেগেছে হিমাদ্রির।


মাঝরাতে কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে ঘরে ঢুকল হিমাদ্রি, না সব ঠিক আছে। সোফার উপরে বইটা তখনও তেমনি পরে আছে। পাশের রুমেই রূপা ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সে ঘুমের মধ্যেও রেগে আছে। রূপার রেগে থাকা মুখের দিকে চেয়ে থেকেও যেন হিমাদ্রির শান্তি শান্তি লাগছে। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু এমনটা করা সম্ভব নয়, রূপার ঘুম ভাঙলে ওর খবর আছে!!! ফ্রিজ থেকে কেক বের করে খেয়েই, বইটা হাতে নিলো হিমাদ্রি, পুরো বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলো। তার অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির জন্য তার নিকট শুধু একটা রাস্তায় খোলা আছে, আর সে রাস্তা ধরে হাঁটার জন্য  হিমাদ্রি ঠিক করলো, সে হিমু হবে। হিমু হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে, কোন মেয়ের দিকে তাকাবে না, কোন মেয়ের হাত ধরবে না। আর রূপা হবে, হিমুর রূপা।


সকাল হয়ে এসেছে। একটি চিরকুট বইটির মাঝে গেঁথে দিয়ে উদাস মনে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। পায়ে কোন জুতো নেই, মানিব্যাগও সাথে করে আনা হয় নি, সাথে যা আছে তার একটি ছোটখাটো বিবরণ দাঁড় করনো যায়- শার্ট, প্যান্ট আর পকেটে ২৫০ টাকা।

২৫০ টাকাও আনা হতো না, আনার পিছনে কারন হচ্ছে, বাসায় কোন হলুদ রঙের পাঞ্জাবী নেই। তাই বঙ্গ থেকে পাঞ্জাবী কিনার জন্যই এই টাকা নিয়ে বের হওয়া। বাসা থেকে বের হতেই একটা লংকা-কাণ্ড ঘটে গেল। দুষ্টু কাক, হিমাদ্রির উপর পয়ঃনিষ্কাশন করেছে। কি পরিমান মেজাজ গরম হয়েছিল  হিমাদ্রির, তা ওকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। তবে কিছুক্ষণ পর, এটাকে সে ভাল দিক হিসেবেই গণ্য করলো। আর নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হোক বা অন্য কোন কারনেই হোক মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো, হিমু হওয়ার প্রথম ধাপ হয়তো এটা। তাই মেজাজ গরম করার কিছু নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা কাগজ তুলে পরিষ্কার করে নিলো জায়গাটা। তারপর আবার আপন মনে হাটতে লাগলো।


আজ পহেলা বৈশাখ। চারদিকে রমণীর অভাব নেই, আর তাদের সাথে আছে সেই চিরচেনা হ্যাবলা-গাবলার দল। রমণীর পেছন পেছন ছুটা ছাড়া এই হ্যাবলা-গাবলা দলের মানুষের আর কোন কাজ নেই। হাইরে, কাপুরুষের দল, নিজেকে কিভাবে সোপর্দ করেছে একটা মেয়ের কাছে!!! দেখলেই ওদের জন্য খুব মায়া হয় হিমাদ্রির।  উদাস ভাবটা আরো কিছুটা বেড়ে যায়। আনমনে গত বৈশাখের কথা আউড়াতে থাকে সে-


গত বৈশাখ!!! হিমাদ্রি, রূপা আর রূপার ছোট ভাই হৃদ্য।  আশুলিয়াই যাচ্ছে, খুব স্পিডে গাড়ি চালায় হিমাদ্রি, এই নিয়ে রূপার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। হৃদ্য তো বেশ এক্সসাইটেড, সবে মাত্র ভার্সিটিতে পা দিয়েছে। চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন। তাই দোলাভাইকে অনেক কষ্টে জোড় করে একটা ইংলিশ গান “আই কেন বি ইউর হিরো” ছাড়তে বাধ্য করলো।


হিমাদ্রি এই যুগের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার রবীন্দ্রপ্রীতি অনেক বেশি। সে এই ধরনের ইংলিশ গান শুনে অভ্যস্ত না। তারপরও কেন যেন গানটা খারাপ লাগছে না। আজকের আকাশটা কিছুটা মেঘলা, হয়তো এই জন্যই সে বার বার রূপাকে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বলছে, কিন্তু ছোট ভাইয়ার সামনে সে গান গাইবে না, ইশারায় বলছে। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে গাড়ির স্পিড আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিলো সে।


বিকেলের রোঁদ যখন গায়ে এসে পড়ছে, মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ রোদের, ঠিক তখনই আশুলিয়ার খেয়া ঘাঁটে এসে পৌঁছালো তারা। নৌকায় উঠেই হৃদ্য চেঁচিয়ে উঠলো, জীবনে মনে হয় প্রথমবারের মত নৌকায় উঠেছে। হিমাদ্রির ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে ফেলে দিতে নৌকা হতে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে রূপা পাশেই আছে। সে ঠিক বলবে,

“আমার ভাইকে পানিতে ফেলেছো, এখন তুমি গিয়ে ওকে উঠিয়ে নিয়ে আসো। তুমি জানো না আমার ভাইটা আমার কত আদরের”

তাই মাথা থেকে ওকে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছাটা ঝেরে ফেলে দিয়ে রূপার দিকে মনোযোগ দিলো সে। মেয়েটাকে শাড়িতে আরো অনেক বেশি ভাল লাগে। নদীর জল থেকে কিছুটা হাতে নিয়ে রূপার দিকে ছুরে মারলো সে। পাশ থেকে হৃদ্য চেঁচিয়ে উঠলো-

“আপনার বউ এর গায়ে পানি ছিটাবেন, ভাল কথা। কিন্তু আমি তো আপনার বউ না, এমনকি আপনার শ্যালিকাও না, আমার গায়ে কেন পানি ছিটাচ্ছেন?”

একটু পরেই ধপাস করে একটা শব্দ হলো, নৌকা দুলছে। আর রূপার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে- সে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি বলছে।


ধানমন্ডি লেক। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে, খেয়ালও নেই। লেকের পানি বেশ ভালই। কপোত-কপোতীরা বেশ সাঁজ-গোঁজ করেই এসেছে দেখা যাচ্ছে। ওদিকটায় এক কপোতী তার কপোতার উপর চিল্লাচ্ছে। মনে হয় তার কপোতার পরিহিত পাঞ্জাবী পছন্দ হয় নি। কেমন যেন উদাস হয়ে এসেছে হিমাদ্রি। সে নিজেকে কনট্রোল করার চেষ্টা করছে। হিমুদের এত সহজে উদাস হলে চলবে না। তাকে আরো অনেক বেশি সংযমী হতে হবে নিজের ব্যাপার গুলো নিয়ে। আর সেই প্রক্ষিতেই ৮নং ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিলো সে, তার উদাস ভাবটা এতে হয়তো কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে হিতে-বিপরীত হতে পারে, সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিকে বেশ হৈচৈ বেঁধে গেলো। কপোত-কপোতীরা সবাই এসে ভিড় জমালো। অনেকে অনেক কথা বলাবলিও করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো পানিতে পুরোপুরি ভিজে যাওয়া কেউ একজনকে লেকের ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হলো। উদাস মনে সে আবার হাঁটা শুরু করলো। পরের গন্তব্য বঙ্গ বাজার।


বঙ্গ বাজার। শরীর কাট পোড়া রোঁদে শুঁকিয়ে গেছে ততক্ষণে। কম হাঁটতে হয় নি তাকে, পুরো ধানমন্ডি এরিয়া পাড় হয়ে, সাহাবাগ হয়ে, প্রেস ক্লাব, পল্টন, তারপর আরো বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষে এই বঙ্গ। ক্ষুধাও লেগেছে প্রচণ্ড। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা শুধু একদিকেই আটকানো- ২৫০ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনতে হবে। কিন্তু এত কম টাকায় কিভাবে পাঞ্জাবী কিনবে, এটা ভেবে টেনশন হচ্ছে, একটা বিড়িও ফোঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু টাকার সল্পতার জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ভেতরে ঢুকল হিমাদ্রি। ঢুকতেই ছেলেদের কাপড়ের সমাহার চোখে পড়লো। প্যান্ট, শার্ট, ট্রাউজারের তো দেখা মেলছে সচরাচর, কিন্তু পাঞ্জাবীর দোকান খোঁজে পাছে না। কিছুক্ষণ পরই একটা হলুদ পাঞ্জাবীর দিকে চোখ পড়লো। হ্যাঁ, পেয়েছে সে। যদিও কিছুটা ইতস্তত হয়েই দোকানদারকে এর প্রাইস কত জিগ্যেস করলো। দোকানদার হাসি মুখে উত্তর দিলো একদাম ২০০,  এরপরের ঘটনাটা কিছুটা এই রকম- হিমাদ্রির মুখে রাজ্যের প্রশান্তির হাসি ফোটে উঠলো যেন মনে হচ্ছে মাত্র জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করে দোকানদারকে দিলো, এরপর সেই জায়গাতেই সেই পাঞ্জাবী পড়ে, তার পরনে থাকা কেটস আইয়ের শার্টটা হাসি মুখে দোকানদারকে গিফট করে রওনা হলো পরের গন্তব্যে।


রূপা,
বিয়ের আগে তোমাকে বলা কথাগুলো ভুলি নি আমি। ঠিক মনে আছে সব। আমি তোমার হিমু হবো, তোমার স্বপ্নের হিমু হবো। আর তুমি রূপার মতো আমার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। মন ভুলানো কথা বলছি না তোমাকে। যা বলছি তা আমি করবই, আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করবই। সেদিন নিশ্চয়ই তুমি খুব খুশি হবে। তোমার ঠোঁটে ঐ হাসির ঝিলিক দেখার জন্যই একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমার নামকে নয়। হিমুরা তো পরিব্রাজক হয়, তাই না? আমিও তাই বেরিয়ে পড়লাম। আমার জন্য ভেবো না। আজ নীল একটা শাড়ি পড়ো রূপা, কপালে একটা নীল টিপ দিও। কেন জানি মনে হচ্ছে নীলের মাঝে রূপা আরও বেশি উদ্ভাসিত হবে। পারলে চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়ো।
ইতি-
হিমু


চিরকুটে লিখা কথাগুলো আউড়াতে আউড়াতে রমনা পার্কে প্রবেশ করে হিমাদ্রি। তার এখন নতুন পরিচয় সে হিমু, অন্তত রূপার জন্য হলেও তাকে হিমু হতে হবে। উদাস হয়ে বেশ কিছুক্ষণ পার্কের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে পানির ধারের একটা বেঞ্চে বসে পড়লো। চারিদিকে রমণী আর বমনাদের আনাগোনায় ভরে গেছে পার্ক। উদাস ভাবটা কাটানোর জন্য একটি বিড়ির খুব দরকার এখন। পিচ্চি একটা ছেলেকে চা আর সিগ্রেট বিক্রি করতে দেখে ডেকে আনলো কাছে।

- কি লাগবো সাব? ছেলেটির মুখে চাঞ্চল্যকর হাসি।

- একটা বিড়ি দে।

- সাব বিড়ি তো বেচি না। সিগ্রেট আছে।

- বেনসোন দে একটা। আচ্ছা তোর নাম কি?

- সাব আমার নাম টিঙ্কু। আপনার নাম কি সাব?

- হিমু।

- এটা আবার কেমন নাম?

- হিমাদ্রি আমার নাম। সেটাকে সংক্ষেপে হিমু বলে বন্ধুরা। তুই বুঝবি না। আচ্ছা টিঙ্কু তুই কত দিন যাবত এই কাজ করস?

- সাব মেলা দিন, যহন বাপে মইরা গেল, তহন থেইকা।

- প্রতিদিন কত কামাস?

- সাব মাঝে মধ্যে একশ, মাঝে মধ্যে বেশি ভাল হইলে দেড়শ, দুইশ। সাব আমি ছোডো বইলা কেউ আমার কাছ থেইকা কিনতে চায় না।

- আচ্ছা শোন, আজকে আমি তোর হয়ে চা আর সিগ্রেট বিক্রি করে দিবো। তুই শুধু আমার পেছন পেছন থাকবি। কেমন?

- না, না সাব। আমার একারই হয় না এই টাকায়। আপনারে লগে নিলে আজকের ভাগে কিছুই জুটবো না।

- আরে বোকা আমি ভাগ বসাতে যাবো কেন? আজ সারাদিন তোর হয়ে চা-সিগ্রেট বিক্রি করে যা টাকা পাবো, তার পুরোটাই তোকে দিয়ে দিবো। কেমন? এবার তো রাজি, নাকি?

- জ্বি আচ্ছা। ঠিক আছে উস্তাদ। আপনারে এখন থেকে উস্তাদ ডাকবো। বাজান মরার আগে কইয়া গেছে, যার কাছ থেকে কিছু হইলেও শিখন যায়, তাকে উস্তাদ বইলা ডাকতে। আইজ আমি আপনার কাছ থেকে কেমনে বেচাকিনি করতে হয়, শিখমু।


এক ফ্লাক্স ভর্তি গরম চা আর সিগ্রেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়লো হিমাদ্রি, পেছন পেছন টিঙ্কু হাঁটছে। একে তো পহেলা বৈশাখ, সেই সাথে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভাল বেচা-কিনি হলো। টিঙ্কু তো তার নতুন উস্তাদের কাজ কর্মে পুরাই ফিদা হয়ে গেছে। সে পাড়লে এখনই কদমবুসি করে নেয়।


পার্কে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হিমাদ্রির চোখ থমকে গেলো একটা জিনিস দেখে। আর সেটা দেখে পেছন থেকে টিঙ্কু বলতে লাগলো

- উস্তাদ দাঁড়াইয়া গেলেন যে? কি হইছে?

- টিঙ্কু কিছু হয় নাই। একটা বড় মাছ পাইছি। ধরতে যাচ্ছি, আমার পেছন পেছন আয়।

টিঙ্কু তার উস্তাদের পেছন পেছন হাঁটছে, উস্তাদ কেউ একজনকে লক্ষ্য করে এগুতে থাকে সামনের দিকে। আর সেই আগানোর ভঙ্গী রপ্ত করায় ব্যস্ত টিঙ্কু। তার কাছে এখন উস্তাদ যা করবে, তাই মধু। সে অবলীলায় দেখতে লাগলো, তার উস্তাদ কোন এক অপরিচিতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো-

- সাব সিগ্রেট অথবা চা লাগবো?

লোকটি এমন ভাবে চমকে উঠলো, যেন মনে হয় কাউকে জীবনেও চা বেচতে দেখনি। টিঙ্কু তো খুব উত্তেজিত কি করছে তার উস্তাদ, সেটা দেখার জন্য। লোকটির সাথে একটা সুন্দরী মেয়েও আছে, যাকে কিনা টিঙ্কুর মনেও ধরেছে। টিঙ্কু মনে মনে ভাবছে বড় হয়ে ঠিক এমন একটা মেয়ের সাথে প্রেম করবে, আর এই পার্কে এসে বসে বসে বাদাম খাবে।

- নাহ, কিছু লাগবে না। অনেকটা ভীত গলায় উত্তর দিলো লোকটি।

- নাহ নাহ, কিছু না নিলে তো হবে না। আপনার জন্য না হয়। আপনার পাশে বসে থাকা আপার জন্য হলেও এই চকলেট টা নিতে হবে।

- আচ্ছা দিন, দাম কতো?

- দুইশ টাকা।

- কি?

- হ্যাঁ, দুইশ টাকা। কেন শুনেন নাই?

লোকটা দিব্যি পকেট থেকে দুইশ টাকা বের করে দিয়ে চকলেট হাতে নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত উঠে চলে গেলো। টিঙ্কুর শ্রদ্ধা তার উস্তাদের প্রতি আরো বেঁড়ে গেলো কয়েকগুণ। কিভাবে সে এত সহজে একটা চকলেট বিক্রি করে দুইশ টাকা পেলো, সেটা নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। বরং দুইশ টাকা আজ এক জনকে ক্ষেপ মেরেই পেয়ে গেছে, সেটার জন্য তার খুশির ইয়াত্তা নেই। সে সাথে সাথে তার উস্তাদকে কদমবুসি করে নিলো। আর অন্য দিকে হিমাদ্রির মুখে তখন রাজ্যের হাসি। ছোট শালা হৃদ্যকে এই অবস্থায় হাতে নাতে ধরে ফেলবে, সেটা কখনো তার ভাবনায়ও আসে নি। হিমু হবার স্বাদ পেয়ে যাচ্ছে সে।


সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আকাশটাও বেশ মেঘলা। টিঙ্কু আর হিমাদ্রি বটমূলের নিচে শুয়ে আছে। খুব ক্লান্ত দুজনেই। হিমাদ্রি উঠে বসলো। তার হাতে এখন অনেক কাজ। পাশ দিয়ে যাওয়া এক রুটি বিক্রেতার কাছ থেকে অবশিষ্ট চল্লিশ টাকা দিয়ে রুটি কিনে সে ও টিঙ্কু খেলো। আজ সারাদিন যত টাকা উপার্জন করেছে তার সব গুলোটাকা টিঙ্কুকে দিয়ে সে উঠে যাচ্ছে। টিঙ্কুর মুখে হাসি এত গুলো টাকা দেখে। সে আরেকবার উস্তাদকে কদমবুসি করে বিদায় জানালো। হিমু হেঁটে যাচ্ছে আর টিঙ্কু একমনে আজ কত টাকা কামিয়েছে তা গুনছে। সে জানে আগামী এক মাসেও হয়তো এত টাকা কামানো হবে না তার। সে আজ অনেক খুশি। উস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় তার চোখের কোণটা চিকচিক করছে, মনে মনে বলছে উস্তাদ আপনি যেখানেই থাকবেন, অনেক ভাল থাকবেন।


প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। হিমাদ্রি আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। কেন যেন রূপার কথা মনে পড়ে উদাস হয়ে পড়লো মন। একটা বিড়ি ফোকানো দরকার এখন। কিন্তু কানাকড়িও পকেটে নেই। রূপার সাথে একবার দেখা করা দরকার। তার মনে হচ্ছে হয়তো যুগ যুগ ধরে  রূপার সাথে দেখা হয় না।


কলিংবেল টিপতেই রূপা দরজা খুললো। তার চোখ লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে আজ সারাদিন সে কেঁদেছে। হিমু নিয়নের আলোয় দেখতে পেলো তার সারা শরীর হলুদ হয়ে আছে। তার বুঝতে বাকী রইলো না যে দুইশ টাকায় কেনা পাঞ্জাবী থেকে রঙ তো উঠবেই। রূপা তরিগরি করে তোয়ালে দিয়ে হিমাদ্রির মাথা মুছে দিচ্ছে আর হিমাদ্রি বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে।

মানব প্রজাতি


আজ আমি শুধু শোনিয়া যাইবো 
কহিবো না কোন কথা,
আঁখি ছলছল, শুধুই অশ্রুজল
জীবনটা কি শুধুই বৃথা !!!

এতদিন যারে চরনে বসালে
আজ ভাবো তারে কদাকার !!!
হায়রে মানবী, মানব সমাজ
সবই অচেনা আমার !!!

যার তরে কেঁদেছে আঁখি
তারে বলো আজ ছিঃ
স্বার্থপর আমি, স্বার্থপর তুমি
স্বার্থপর এই মানব প্রজাতি!!!

________।।।।_________

"অঙ্গ"


চোখ তুমি অশ্রু দিও না,
দিও আলোর হাতছানি। 

মুখ তুমি মিথ্যা বল না, 
বল ভালবাসার বাণী। 

কান তুমি ভুল শুননা,
শোন বিজয়ের ধ্বনি।

হাত তুমি যুদ্ধ কর না,
দিও স্নেহের পরশখানি।

পা তুমি বিপথে চল না,
চিনে নিও সঠিক পথখানি।

মন তুমি মন ভেঙো না,
গড় স্বপ্নের ভুবনখানি।

জরাজীর্ণতা !!!


অন্ধকার ছোট্ট একটি ঘর, জানালার ফাঁক দিয়ে কিছুটা আলো এসে মেঝেতে পরে থাকা পানির উপর পড়ছে, আর সে আলোতে ঘরের দেয়ালটাতে কিছু প্রতিকৃতি সৃষ্টি হচ্ছে। স্যাঁতস্যাঁতে এই বাড়ির নিচ তলায় নির্ঘুম দুটি আত্মার বসবাস। পুস্পা আর মুহিত।

ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিকেই পুস্পা আর মুহিতের পরিচয়। পরিচয়টা অন্যান্য সবার মত খুবই সাদা-মাটা। ওদের সম্পর্কও অন্যান্য বন্ধুর চেয়ে ভিন্ন ছিলো না। ক্লাস, আড্ডা, গান, ক্যাফে সব মিলিয়ে ভালই যাচ্ছিলো ওদের সময়। মাঝে মাঝে বেশ রাত করে ঘরে ফেরায় মা’র কাছ থেকে কম কথা শুনতে হয় নি পুস্পার, তারপরও মুহিতের সঙ্গ পুস্পার সব সময়ের মত ভাল লাগতো।

দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পায় পুস্পা। মুহিত হয়তো চলে এসেছে। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয় তাকে। মুহিত সারাদিন পর বাসায় ফেরে। হাত মুখ ধোয়, ওকে বিছানা থেকে উঠিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। তারপর ওকে আবার শুইয়ে দিয়ে বাসার কিছু কাজ করে পুস্পার হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

মুহিতের কাছে ঘরের লকারের চাবি রয়েছে। ও কেন দরজায় টোকা দিবে? পুস্পার মনে কিছুটা আতংকের ছায়া কিছু সময়ের জন্য ঠায় পেলো। কে আসলো এই অবেলায়? স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটা পুস্পার মনের ভেতরটাকেও কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলছে এই কয়েকদিনেই। মুহিত পাশের বাসায় কাজের মহিলাটিকে ঘরটা মুছে দিতে বেশ কয়েকবার বলার পরও মহিলা আসে নি। মুহিত ঠিক করেছে আজ সে নিজেই এর ব্যাবস্থা করবে। বিছানা ছেড়ে উঠতেও পারছে না পুস্পা। ভেতর থেকেই আতংকের স্বরে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলো- “কে?” ওপাশ হতে বেশ জোড়াল কন্ঠ শোনা গেলো- “ভাড়ার জন্য এসেছি, মালিক পাঠিয়েছে।” কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল পুস্পা। আজ যে মাসের দশ তারিখ হয়ে গিয়েছে খেয়ালও নেই ওর। মুহিত আসলে ওকে ভাড়ার কথা বলতে হবে। “আপনি যান, আমি ভাড়া পাঠিয়ে দিবো আজ-কালকের মধ্যেই।”

পুস্পা আবার শুয়ে পড়লো বিছনায়, খুব বেশি অসহ্য লাগছে এই দুনিয়া-দারী। দেয়ালের উপর সৃষ্টি হওয়া প্রতিকৃতি গুলো আনমনে দেখতে লাগলো। মাত্র তিনদিন আগেও নিজের স্বাচ্ছন্দ্যে সে ঘরের সব কাজ করতো। কিন্তু এখন সে অসহায়ের মত বিছানায় পড়ে আছে। মুহিতের কড়া নির্দেশ কোন মতেই বিছানা ছেড়ে উঠা যাবে না।

সবে মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছিল ওরা। পুস্পার বাসা থেকে পুস্পার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। খুব শীঘ্রই অ্যামেরিকায় সিটিজেন এক ভাল পাত্রও পেয়ে যায়। পাত্রের নাম অভিমান্য চক্রবর্তী। পুস্পারাও চক্রবর্তী বংশের। পুস্পার পুরো নাম হচ্ছে সুরভী রাণী পুস্পা চক্রবর্তী। আর মুহিতের পুরো, মোঃ জুনাইয়েদ হোসেন মুহিত।

বিয়ে ঠিক হবার দুদিন পর মুহিতের সাথে পুস্পার দেখা হয়।  “কিরে পুস্পা, এই দুই দিন কই ছিলি?” “তেমন কিছু নারে, একটু অসুস্থ ছিলাম।” “সুপ্তা বলল, তোর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রে। তা পাত্র কি করে রে? শুনলাম অ্যামেরিকায় নাকি সিটিজেন? বিয়ের পর দেশেই থাকবি? নাকি চলে যাবি বাইরে?” “বাদ দে রে এসব কথা। ভাল্লাগতেছে না। আচ্ছা, মুহিত তুই কি একটা গান শুনেছিস?” “কি গান দোস্ত?”“Somebody wants you Somebody needs you Somebody dreams about you every single night Somebody can't breath without you, it's lonely Somebody hopes someday you will see That Somebody's Me.” “হ্যাঁ তো দোস্ত শুনছি, এনরিকের গান, কেন রে?” “নাহ, এমনি। আচ্ছা শোন কেউ যদি তোকে এই গানটা শুনায়ে প্রপোজ করে, তুই কি রাজী হবি?” “আরে গাঁধি, দেশে কি ছেলের আকাল পরেছে যে, মেয়েরা আমার মত গাধাটাকে এই গান শুনিয়ে প্রপোজ করবে?” “যদি আমি করি?” মুহিত চুপ-চাপ দাড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে পুস্পার চলে যাওয়া দেখতেই যেন বিষণ্ণতা এসে দমিয়ে দিয়ে গেলো ওকে।


নাহ এভাবে আর কত দিন! বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে কোমরও ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। খুব কষ্ট হয় পুস্পার। বুকের ভেতরটা মাঝে মাঝে হাহাকার করে উঠে। একটা মানুষকে আর কত চাপ দিবে সে! সারা দিন বাইরে বাইরে থাকে। দিন শেষে বাসায় এলেও যদি একটু শান্তি না পায়, তাহলে কতটা কষ্ট লাগতে পারে? ভাবতেই কষ্টের পরিমানটা বেড়ে যায় পুস্পার।

দীপশিখা যেথা জ্বলে সেথা নয় মোর বাস,  যেথা পাখি রয় মেঘের গর্জন  বৃষ্টির বসবাস সুদূর সবুজ ঘাস- সেথা নয় মোর বাস।।

আঁধার কালো কুটীর যেথা দীপশিখার প্রদীপ বৃথা, বদ্ধ কারাগার স্যাঁতস্যাঁতে বাতাস শুধুই দীর্ঘশ্বাস- সেথা মোর বাস।। দুঃখের নির্বাস।

নিজের লেখা কবিতাটি আউড়াতে আউড়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে পুস্পা। ঘরের অবস্থা তিন দিনেই বেহাল। ঘরের গৃহিণী যদি কাজ না করে ঘরের, সেটাকে কি আর ঘর বলা যায়? মুহিতের কড়া নির্দেশ অমান্য করে বিছানা ছেড়ে উঠলো পুস্পা। দুই দিন হলো ঘরের বাতিটাও ফিউজ হয়ে গিয়েছে, আপাতত ডিম লাইট দিয়েই যাবতীয় কাজ চালাতে হয়। মুহিতকে বলে একটা লাইটেরও ব্যাবস্থা করতে হবে। অন্ধকার ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসে। এখনো হাতে অনেক কাজ বাকী, পুরো ঘরটা পরিষ্কার করতে হবে। মুহিতকে রাতের খাবার কিনে আনতে মানা করে দিতে হবে। আজ নিজের হাতে রান্না করবে পুস্পা। ঘরের মেঝে পরিষ্কার করতে হবে। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে পুস্পা। সে কাজের মাঝে রয়েছে তৃপ্তির ছোঁয়া।

পুস্পা বেশ কিছু দিন ভার্সিটিতে আসে নি। আর অন্যদিকে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই মুহিত দিনগুলো পাড় করলো। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব পেছনে ফেলে পুস্পার বাসায় এসে হাজির মুহিত। পুস্পার রুমে পৌঁছাতে তেমন কোন বেগ পেতে হয় নি ওর, কারন প্রায় নিয়মিতই পুস্পার বাসায় আসা হয় ওর। “পুস্পা!” “আরে মুহিত, তুই!” “হুম” “হঠাৎ করে কেন আসলি? জানালিও না?” “নাহ এমনি রে। আচ্ছা তোর বিয়ের তারিখ কবে?” “কেন?” “নাহ এমনি, বল কবে?” “আগামী মাসের ২ তারিখ।” “আজ তো ১৮ তারিখ, আর মাত্র ১৪ দিন বাকী। আমাকে ছাড়া সুখে থাকবি?” “জানি নাহ।” “বল, থাকবি?” “নাহ” অনেকটা মলিন স্বরে পুস্পার মুখ থেকে কথাগুলো বের হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, পুস্পা কাঁদছে। কিন্তু উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকায়, দেখতে পায় নি মুহিত। মুহিতের ভেতর কেমন ব্যাথা অনুভূত হলো। এত কাছ থেকে কখনো পুস্পাকে কাঁদতে দেখেনি ও।

ঘরের কাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু রান্নাটা বাকী। মুহিতের আসার সময় হয়ে এসেছে। আজও হয়তো তিনটে টিউশনি করিয়ে ফিরবে। বেচারাকে এখন অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়। পুস্পা কিছুদিন আগেও মুহিতকে সাহায্য করতে পারতো। যেখানে মুহিত দুই থেকে তিনটে টিউশনি করিয়ে যা পেতো, তাঁর সাথে পুস্পার একটি টিউশনির টাকা যোগ হতো। বেশ ভাল ভাবেই চলে যাচ্ছিলো দিন।

ওদের পড়ালেখা শেষ আজ প্রায় ছয়-সাত মাস। মুহিত বেশ কয়েক জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউও দিয়েছে। এখনো তেমন কোন ফলাফল আসে নি। মুহিতের জন্য বড্ড বেশি কষ্ট হয় পুস্পার। সে যদি পারতো তাহলে সত্যি অনেক কিছু করতো মুহিতকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু শরীরের এই অবস্থার কারনেই পারছে না। ইদানীং নিজের উপর খুব বিরক্ত লাগে ওর।


হ্যাঁ, যেমনটা হবার কথা ছিলো, তেমনটাই ঘটেছে। পুস্পা কিংবা মুহিত, কারো বাসা থেকেই তাদের বিয়ে মেনে নেয় নি। এক বন্ধুর সাহায্যে শহরের শেষ প্রান্তে জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে উঠে তারা। পড়ালেখার পরিসমাপ্তিও বেশ ভাল ভাবেই সম্পন্ন করে তারা। আজ ওদের বিয়ের প্রায় চার বছর। কে বলে ভালবাসার মানুষটিকে বিয়ে করলে সুখী হওয়া যায় না?! বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে ভাবে পুস্পা।


হঠাৎ ঘরের দরজার লকার খোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুহিত চলে এসেছে, হাতে কতগুলো ব্যাগ। বিস্ময়ের চোখে পুস্পা ব্যাগগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিত একটা ব্যাগ পুস্পার দিকে বারিয়ে দেয়। পুস্পা ব্যাগের ভেতর একটি লাল শাড়ি দেখতে পায়। মুহিত বলে উঠে- “শুভ বিবাহবার্ষিকী ম্যাডাম। কখনো তোমাকে একটি শাড়িও কিনে দিতে পারি নি বলে আমি সত্যিই খুব লজ্জিত বউ। তোমার স্বামীর এই অপরাগতাটুকু ক্ষমা করে দিয়ো।” পুস্পার চোখ ছলছল করছে। ও কিছু বলে উঠার আগেই, মুহিত উঠে দাঁড়ালো, আরেকটি ব্যাগ থেকে একটি বাল্ব বের করে লাগাতে লাগাতে বলল- “একটা চাকরি কনফার্ম হয়েছে আজ। আর টিউশনির কিছু টাকাও পেলাম। বাড়ি ভাড়াটাও নিয়ে এসেছি। আজ দিয়ে আসবো। আচ্ছা বউ তুমি, আসার পর থেকে একটা কথাও কেন বললা না? শাড়ি পছন্দ হয় নি তোমার? পুস্পা মুহিতকে ইশারায় বিছানার পাশে এসে বসতে বলল। তাঁর চোখের নিচটা এখন অশ্রুসিক্ত। মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে হাজারো কথা বলার ছিল, বলতে গিয়েই আটকে যাচ্ছে। মুহিত পুস্পার হাতটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। পুস্পার মনে হয় এই মানুষটির মত ভাল মানুষ হয়তো আর একটিও নেই। তাঁর গর্ভে এই মানুষটির সন্তান ধারণ করাটাও যেন তাঁর কাছে স্বর্গীয় কিছু।  

অঙ্কুর.........।।


ভোর ৪ টা, প্রতিদিনকার মত আজও দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো সাদাতের। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। চোখ বড় বড় হয়ে কোটর থেকে বের হয়ে যেতে চাঁচ্ছে, মুখ থেকে সাদা আঠালো জাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে আর হাঁপানি রোগীর মত অঙ্গভঙ্গি করে মাথাটা এদিক-উদিক দোল খাচ্ছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা এই ছোট্ট মাথাটার ভেতর এসে ভর করছে। চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, কোথাও কোন আলো নেই। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাথার যন্ত্রনায় খাটের পাশে রাখা পানির গ্লাস পর্যন্ত হাত যাচ্ছে না। দুঃস্বপ্নের রেশ কাঁটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে পুনরায় সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নিঃশ্বাস নেওয়া থেকে শুরু করে মাথায় যন্ত্রণা পর্যন্ত সব আবার স্বরূপে কাজ করতে শুরু করবে। ঘুম ভাঙ্গার পরের পর্যায় থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসাতে ঠিক দশ মিনিট সময় লাগে। এই দশ মিনিট সাদাতের কাছে অনন্তকাল মনে হয়। আর এক অনন্তকালের যন্ত্রণা শেষে আবার ঘুমোতে যাবে সে।


বর্ষাকাল!!! বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সাদাতের বাবা, জয়ন্ত বৃষ্টির কারনে আজ অফিসে যেতে পারে নি। একই কারনে আজ সাদাতেরও স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাসায় বাবা আর মাকে নিয়ে সাদাতের বসবাস। ছুটির দিনগুলো ব্যাতীত অন্যান্য দিনগুলোতে পরিবারের সাথে ভাল সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে উঠে না জয়ন্তের। অধিকাংশ সময়ই অফিসের কাজে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এদিকে স্বামী-সন্তানকে একসাথে পেয়ে সাদাতের আম্মু, সৌমিতার খুশির অন্ত নেই, সারাদিন কখন কি রান্না করবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে। আর সেই সুযোগে বাবা আর ছেলে মিলে বৃষ্টিতে ভেজার প্ল্যান করে ফেলেছে। প্ল্যানে অবশ্য সৌমিতাও রয়েছে। সৌমিতাকে একবার বলা হবে, যদি না রাজি হয় তবে বাবা আর ছেলে মিলেই নেমে যাবে বৃষ্টিতে। তবে আরেকটা ব্যাপার রয়েছে, সেটা হলো সৌমিতাকে এই প্ল্যানের কথা জানানোর সাহস বাবা কিংবা ছেলের কারোরই হচ্ছে না। তারা জানে, সৌমিতা বৃষ্টিতে ভেজা একদম পছন্দ করে না, কারন তার ধারণা বৃষ্টিতে ভিজলেই শরীরে জ্বর চলে আসে। এর পেছনে অবশ্য ছোট বেলায় বৃষ্টিতে ভিজে টানা সাত দিনের জ্বরে ভোগার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সৌমিতার। এরপর থেকে আর কখনই বৃষ্টির আশেপাশেও যায় না সে। তাই বরাবরের এবারও হয়তো তাদের একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা হবে না। এই ভেবেই সাদাতের হাস্যজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ-ই কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে এলো।


সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। জমিসংক্রান্ত কিছু ঝামেলায় পড়ায় দ্রুতই গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়ন্ত, তাছাড়া অনেক দিন যাবত গ্রামে যাওয়া হয় না, এই সুযোগে গ্রাম থেকেও ঘুরে আসা যাবে। গ্রামে তেমন কেউ নেই জয়ন্তের। দূর সম্পর্কের এক চাচাই সব জমিজমার দেখা-শুনা করে আসছেন এতদিন যাবত। হঠাৎ-ই চাচার মৃত্যুর খবর আসে, আর সেই জন্যই মূলত অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নেয় সে। আজ রাতের লঞ্চের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু এই বৈরি আবহাওয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কিভাবে বের হবে এই নিয়ে চিন্তায় পরে গেছে জয়ন্ত। আর অন্যদিকে সৌমিতা ব্যাগ গুছানো নিয়ে ব্যস্ত। সাদাত তার দশ বছরের জীবনে লঞ্চে চড়েছে মাত্র তিনবার, তাও শেষ বার যখন চড়েছিলো, তখন তার বয়স ছিলো ছ’বছর। তাই লঞ্চে উঠার অভিজ্ঞতা তার তেমন মনেও নেই। তাই আজ লঞ্চে করে গ্রামে যাওয়ার উত্তেজনাটা তার মধ্যে যেন একটু বেশিই কাজ করছে। সারাদিনের ঝুম বৃষ্টির পর সন্ধ্যায় বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমে যাওয়ায় জয়ন্ত, স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে লঞ্চের উদ্দেশ্যে সদরঘাট রওনা হয়।


হঠাৎ ঝাকুনিতে কেবিনের এক কোণে জ্বলতে থাকা সোডিয়াম বাতিটি সশব্দে নিভে গেলো। কেবিনের জালানা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বৃষ্টির প্রকটতা দেখে সৌমিতা চমকে উঠলো। পুরো কেবিনটা কেমন যেন শীতল হয়ে আছে। সে তার দশ বছরের ছেলেকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যাতে করে এই বৈরি আবহাওয়ার কোন প্রভাবই এই ছোট্ট আদরের ছেলের উপর না পড়ে। জয়ন্ত বাইরে কি হচ্ছে তা জানার জন্য কেবিন থেকে বের হয়, তাছাড়া বাতিটারও কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বাইরে প্রচণ্ড শব্দে ঝড় হচ্ছে। ঝড়ের তীব্রতার কারনে নদীর উপর লঞ্চ চলাচল আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। লঞ্চকে নদীর এক পাশে এনে কোন রকমে ভিড়িয়ে রাখেছে লঞ্চ কর্মীরা। লঞ্চে ডেকের উপর শুয়ে বসে আছে শত শত মানুষ, আর তাদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। জয়ন্ত একবার বাইরের দিকে তাকালো, নদীর পাড়ের গাছগুলো বাতাসের তীব্রতায় মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে লঞ্চের উপর এসে পড়বে, হঠাৎ এক অজানা আতঙ্ক এসে জয়ন্তকেও আতঙ্কের রাজ্য থেকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো। জয়ন্ত নির্বিকার ভঙ্গীতে কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো। লঞ্চের ছাঁদ থেকে বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দ আসছে। কেবিনের ভেতরটা কেমন যেন আরো শীতল হয়ে যাচ্ছে, সৌমিতা তার দশ বছরের ছেলেটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বৃষ্টির শব্দ সবসময়কার মত এবারও জয়ন্তকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিলো। ঘোরের বসেই সে গাইতে শুরু করলো বৃষ্টির গান.........

যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।

এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।

যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
……………………………………………………………………………………………………………



 হঠাৎ-ই বাইরে খুব হট্টগোল শোনা যাচ্ছে, হট্টগোলের শব্দে সাদাতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়িতে ঠিক চারটা। খুব শীতে কঁপুনি দিয়ে উঠছে সে। কেবিনে কেউ নেই, না বাবা, না মা। সে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে কেবিন থেকে বের হলো। ঐতো দূরে অনেক লোকের ভিড়ে বাবাকে দেখা যাচ্ছে। আর মা! সে দ্রুত ভিড় ঠেলে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কোন এক ডাক্তার ধরনের লোক ডেকের উপর সৌমিতাকে শুইয়ে প্রেসার মাপছে। সৌমিতার মুখ থেকে অনর্গল সাদা আঠলো জাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে আর হাত-পা বাঁকা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো সে। অনেক লোক এসে ভিড় জমিয়েছে তার চারপাশে। খুব অস্বস্তি লাগছে তার, বারবার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাঁপানি রোগটা তার সাথে ছোট বেলা থেকেই, কিন্তু আজ হঠাৎ করে এইভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, সে ভাবতেও পারে নি। সাথে করে ইনহেলারও আনতে ভুলে গেছে সে। বারবার সে জয়ন্তের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো, সে মুখটাতে অসহায়ত্ব আর অন্যায়বোধের ছাপ। জয়ন্ত কেন যে মনে করে ইনহেলারটা আনতে বলে নি সৌমিতাকে, সেই অন্যায়বোধ। সে তো জানতই যে তার সৌমিতাটা কতটা ভুলোমনা। জয়ন্তের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৌমিতা, আর সাদাতকে নিজের কাছে টেনে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো সে। সাদাত জানে না, তার মা তাকে সারা রাত আগলে রেখেছিলো, কেননা সৌমিতা জানতো ঐ বৈরি আবহাওয়াই তার ছোট্ট ছেলেটার, ছোট্ট শরীরে হাঁপানির যে বীজ আছে, তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। জয়ন্তকে পাশে টেনে মলিন হাসি হেসে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে লাগলো সে। হয়তো বলেছিলো, তার সন্তানটাকে যেন মায়ের আর বাবার আদর দিয়ে সারা জীবন আগলে রাখে। জয়ন্তের চোখে পানি, গাল ভিজে গেছে পানিতে। এটা দেখে সৌমিতার খুব কষ্ট হচ্ছে। জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে, বলতে গিয়ে ধীরে ধীরে চোখটা বন্ধ করে ফেলল সৌমিতা।


 ঘড়িতে ৪ টা বেজে ৫ মিনিট। আর ঠিক ৫ মিনিট পরই সাদাতের সকল ইন্দ্রিয় পুনরায় ঠিক মত কাজ করা শুরু করবে। সেদিনের ঐ ঘটনার পর থেকে প্রায় রাতের ঠিক ৪ টায় সাদাতকে একবার করে এই অনন্তকালের বেদনা পোহাতে হয়। সে বসে থাকে সেই অনন্তকালের শেষ দেখার আশায়......।।

কায়া


সারা দিনের উত্তপ্ত সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাকাডাকি শুরু হয়ে গিয়েছে। বসন্তের দমকা হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। চারদিকে আধো-আলো আধো-ছায়ার খেলায়, মফস্বলের আঁকাবাঁকা রাস্তাটি থমথমে হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসবে চারপাশ, ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাকাডাকির শব্দ মাইল দুই-এক দূরে থেকেও শোনা যাবে। রাত কিছুটা গভীর হওয়ার সাথে সাথে চারদিক স্তব্ধ হয়ে আসে। তখন দূরে কিছু ছোট চায়ের দোকান ছাড়া আর কোথাও কোন হলদে আলো থাকে না। তবে রাস্তার পাশ ঘেঁষে থাকা জোনাকি পোকার আলোতে যে কেউ নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারবে খুব সহজে। মাঝে মাঝে কিছু গাড়ি চলাচল করে, রাত বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির আনাগোনাও কমে যেতে যেতে এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। দূরে ছোট চায়ের দোকান গুলোর হলদে আলোও আস্তে আস্তে নিভতে শুরু করে। তখন রাস্তার পাশে মাঠ বরাবর তাকালে কোটি-কোটি জোনাকির দেখা মেলে, নিজেকে মনে হয়-ভুল রাস্তা ধরে জোনাকি রাজার দেশে ঢুকে পড়া, পথভোলা এক অপরাধী আগন্তুক।   

উতপ্ত দিন শেষে রাস্তার পাশে লাগানো গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে হাজারো পাখির নীড়ে ফেরার এক অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে সুনীল। তার হাতে কালো পেট মোটা ব্যাগ। সুনীল খুব আগ্রহ নিয়ে তার চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে। দমকা বাতাস এসে তার হাতের ব্যাগটাকে দোল খাওয়াচ্ছে। এদিকে লক্ষ্য না দিয়ে নিজের মত করে চারপাশ পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত সে। শৈশবে খুব ডানপিটে আর চঞ্চল থাকা সত্ত্বেও বড় হবার পর একদম গম্ভীর আর শান্ত হয়ে যায় সুনীল। কেন যেন ওর মনে হয়-সব ডানপিটে বাচ্চারাই বড় হয়ে গম্ভীর হয়ে যায়। এর পেছনে একটা যুক্তিও দাঁড় করিয়েছে সুনীল, সেটা হলো-শৈশবে এই ধরণের বাচ্চারা এত বেশি দুষ্টামি করে যে, জীবনের বাকি সময়টা ওই স্মৃতিগুলো মনে করেই অনায়াসে কাঁটিয়ে দিতে পারে। সুনীলের চারপাশ পর্যবেক্ষণ চলছেই। পর্যবেক্ষণের এক পর্যায়ে সে লক্ষ্য করলো, একটা কালো রঙের কুকুর বেশ অনেকক্ষণ যাবত ওর পেছন পেছন হাঁটছে। ও হাঁটলে কুকুর হাঁটে, ও থামলে কুকুরও থেমে যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে কুকুরের দিকে তাকাতেই কুকুরটি এমন ভাবে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়, যাতে করে মনে হবে-কুকুরটি সুনীলকে দেখেই নি, পেছন পেছন হাঁটা তো অনেক দূরের কথা। কুকুরের মতলব ভাল ঠেকছে না সুনীলের কাছে, সে তার কালো পেট মোটা ব্যাগটাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরলো।

এমনই এক বসন্তের দিনে প্রথম দেখা হয় সুবর্নার সাথে। সুনীলের বন্ধু জয় এর ক্লাসমেট ছিল সুবর্না, ওদের ভার্সিটির কোন এক অনুষ্ঠানে সুনীলকে সাথে করে নিয়ে যায় জয়, আর পরিচয় করিয়ে দেয় ওর সব বন্ধুদের সাথে। সবার মাঝে সুবর্নাও ছিল, নীল শাড়িতে উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ। সুনীলের সাথে পরিচয়ের সময় ভদ্রতার খাতিরে একটু হেসেই সেখান থেকে বিদায় হয় সুবর্না। সকলের ভিড়ে সুবর্নাকে একটু আলাদাই লেগেছিল সুনীলের, কেমন যেন খুব চুপচাপ। চোখের মধ্যে সারাক্ষণ জল ছলছল করছিল, সুনীলের মনে হয়েছে অনেক কথা লুকোনো আছে এই জল ছলছল চোখের অন্তরালে।

কুকুরটা এখনো পেছন পেছন হাঁটছে, খুবই অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সুনীল। আরেকটু সামনে এগুলেই মোড় আর সেখানে দঁড়িয়ে আছে ছোট একটা চায়ের দোকান। ওটাকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ সামনের আঁকাবাঁকা রাস্তায় নিজের ছায়া দেখে, সুনীলের বুঝতে অসুবিধে হয় না - পেছন থেকে গাড়ি আসছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কোন কারন ছাড়াই গাড়িটি অনবরত হর্ন দিয়েই যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি, তা জানার জন্য পেছন ফিরে গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। গাড়ির একপাশের জানালা খুলে মাথা বের করে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক মেয়ে। ছলছল চোখে সুনীলকে উদ্দেশ্য করে জিগ্যেস করে- এক্সকিউজ মি, বলতে পারবেন মেহেরপুরে যাওয়ার রাস্তা এটাই কিনা? সুনীল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে, মেয়েটি দেখতে ঠিক সুবর্নার মত।


জয়ের জন্মদিনে দ্বিতীয় বারের মত দেখা হয় সুবর্নার সাথে। পড়নে ছিল নীল রঙের জামা। সুবর্নার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সুনীল, ওকে উদ্দেশ্য করে বলে-- আচ্ছা, আপনার প্রিয় রঙ কি নীল? - নাহ, কিন্তু কেন বলুন তো? - নাহ মানে, আজ নিয়ে আপনার সাথে দুইবার দেখা হলো। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল দু’বারই আপনার পড়নে নীল রঙের কাপড় দেখলাম তো, তাই আর কি। - ও আচ্ছা, আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার প্রিয় রঙ কি তা আমার জানা নেই, বলতে পারেন কখনো জানার ইচ্ছেও হয় নি। আম্মুর প্রিয় রঙ নীল। তাই তিনি তার একমাত্র আদরের মেয়েটাকে নীল রঙে রাঙিয়ে রাখার চেষ্টা করেন সবসময়। - বাহ দারুন তো। একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন? - কি ব্যাপার? - আমার নামের শেষেও নীল রয়েছে। তারমানে আপনার আম্মু আমাকেও পছন্দ করবে। কথাগুলো বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকে সুনীল। এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত, বুঝতে না পেরে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে সুবর্না। সুনীল আবার বলতে শুরু করে- এরচেয়েও মজার ব্যাপার আছে, সেটা কি জানেন? আমার আর আপনার দু’জনের নামের সাথেই সু শব্দটা রয়েছে। সু শব্দটির অর্থ কি আপনার জানা আছে? - সু শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই। একেক সময় একেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই যেমন, আমার নামে সু এর অর্থ হচ্ছে সুন্দর আর আপনার নামে সু এর অর্থ হচ্ছে পবিত্র।  

বলতে পারবেন মেহেরপুরে যাওয়ার রাস্তা এটাই কিনা? সুনীল ভাবনার রাজ্য থেকে আচমকা কানে আসা শব্দে ধপাস করে ভূমিতে আঁচড়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়- জ্বি, একটু সামনে এগুলেই একটা মোড়, মোড় থেকে বায়ে সোজা এগিয়ে গেলেই মেহেরপুর। মেয়েটি ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ির জানালাটি লাগিয়ে দিলো। গাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, সুনীল হাতে পেট মোটা ব্যাগ নিয়ে অনড় দাঁড়িয়ে গাড়ির পেছনের লাল বাতিটির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া দেখছে।


শীতকাল, জয়ের ভার্সিটিতে পিঠার উৎসব চলছে। অনিহা সত্ত্বেও জয়ের সাথে সেবারও সেখানে যেতে হয় সুনীলের। বিশাল পরিসরে উৎসব চলছে। গায়ের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট ছোট খোপের মত অনেক গুলো পিঠার স্টল। সুনীলের পিঠার প্রতি তেমন কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে, তারপরও বন্ধুর আবদার রাখতেই এখানে আসা  অথবা সুবর্নাকে আরেকবার দেখতে আসা। স্টলগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই দেখা মেলে সুবর্নার সাথে। একটি স্টলের এক কোণে চুপটি মেরে বসে আছে, পড়নে আবারো নীল রঙের শাড়ি। আজ সুবর্নার চোখ একটু বেশিই ছলছল করছে। জগতে এক প্রজাতির মানুষ আছে, যারা কখনো কাঁদতে জানে না। খুব কষ্টেও তারা হাসতে পারে। একমাত্র তাদের চোখ দেখেই বুঝা যায়, কতটা কষ্ট তারা চেপে রেখেছে নিজের মাঝে। কেন যেন সুবর্নাকে দেখে আজ খুব কষ্ট হচ্ছে সুনীলের।


কুকুরটি এখনো পেছন পেছন হাঁটছে। এত রাত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কুকুরটি কেন পেছন পেছন হাঁটা ছাড়ছে না, এই নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই সুনীলের। প্রথমে যেভাবে ভয় পেয়েছিল, এখন আর ততটা ভয় লাগছে না তার। কেননা সুনীল বুঝতে পেরেছে কুকুরটি তাকে কামড়াতে আসবে না, যদি কুকুরটির ওই রকম কোন কুমতলব থাকতো, তাহলে এতক্ষণ ধরে পেছন পেছন না হেঁটে কিছু একটা কাণ্ড করে বসতো। এই ভেবেই দুশ্চিন্তার রেশ কেটে গেলো তার। হাঁটার গতি কিছুটা ধীর করে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে মোড়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সুনীল।


সুনীল-সুবর্নার ভালবাসার অধ্যায় ঠিক কবে শুরু হয়, তা সঠিক করে কারো জানা নেই। একদিন জয় সুনীলকে সরাসরি জিগ্যেস করেও সঠিক কোন দিন তারিখ বের করতে পারে নি ওর কাছ থেকে। আমরা ধারণা করে নেই, সেই পিঠার উৎসব থেকেই শুরু হয়ে যায় সুনীল-সুবর্না অধ্যায়। এরপর দিন কাটে, দিনে দিনে গড়ে তুলে মাস, আর মাসে মাসে মিলে বছর। সুনীল-সুবর্নার ভালবাসা দিনের পর দিন আরো মজবুত আর অটুট হয়েই চলেছে। কোন এক মেঘলা দিনের কথা, সুনীল সুবর্নার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ভালবাসায় দীপ্ত দুটি প্রাণ। সুনীল সুবর্নার অনেকটা আছে চলে আসে, আরো কাছে, সুবর্নার নিঃশ্বাস সুনীলের নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যায়। দূর-দূরান্তে পাখীদের কিচিরমিচির। সুনীল সুবর্নার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে- “ভালবাসি।”

সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দেয় সুনীল। কিন্তু চায়ের স্বাদটা ভাল লাগছে না তার কাছে, কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে আছে চা টা, চিনির পরিমাণটাও খানিকটা কম। মুখটাকে এক নিমিষেই তেঁতো করে ফেলেছে, ইচ্ছে করছে চায়ের কাঁপটা ছুড়ে ফেলে দিতে। কিন্তু কিছু করার নেই, সারা দিন শেষে মাথাটা কিছুটা ধরেছে ওর, তাছাড়া আশেপাশে আর কোন দোকানও খোলা নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠাণ্ডা চায়েই চুমুক দেয় সুনীল।


এক শীতের রাতে চায়ের কাঁপে চা ঢালতে গিয়ে হাত থেকে পরে যায় চায়ের পাতিল। গরম চা এসে পায়ে পড়তেই ঝলসে যায় পায়ের চামড়া। খেয়াল নেই সেদিকে সুনীলের, চোখ নিবদ্ধ হয়ে আছে সদ্য হাতে আসা সাদা পৃষ্ঠার উপর গুঁটি গুঁটি হরফে লিখা একটা চিরকুটের দিকে। হ্যাঁ সুবর্নার লেখা চিরকুট।

“প্রিয় সুনীল, তোমার সাথে জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমি সুখের সর্বচ্চো শিখরে আরোহণ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে তোমাকে লেখা আমার প্রথম ও শেষ চিঠি। তোমার সাথে এতদিন থেকে আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি, খুঁজে পেয়েছি শহরের ইট বালুতে চাপা পড়ে যাওয়া সদা হাস্যজ্বল সেই মেয়েটিকে। তোমার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে কাউকে নির্লিপ্তভাবে ভালবাসা যায়, কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে। তোমার কাছ থেকে জানতে পেরেছি জীবনে বেঁচে থাকার রহস্য, জীবনটাকে ভালবাসতে শিখেছি তোমার কাছ থেকে। নীল রঙা আকশের নীল রঙ ছুঁতে শিখেছি তোমার হাত ধরে, মেঘ টেনে মাটিতে নামিয়ে আনতে শিখেছি তোমার কাছ থেকেই। তোমার সাথে থেকেই খুঁজে পেয়েছি আমার প্রিয় রঙ কে, ঘুটঘুটে কালো রাতে চাঁদ উঠলে, তোমার সমগ্র শরীর জুড়ে যে রঙ খেলা করে, সেই রঙটা। অনেক অনেক কিছু পেয়েছি তোমার কাছ থেকে, কিন্তু দেওয়ার মতো কিছুই দিতে পারি নি। আজ একটা জিনিস দিবো তোমাকে, আর তা হলো ‘মুক্তি’। হ্যাঁ তোমাকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছি আমার অযাচিত এই জীবন থেকে। তোমার ভালবাসার মূল্য দিতে পারি নি কখনো, তাই আমাকে মাফ করে দিয়ো। ভালবাসার অপর নাম কি শুধু কাছে পাওয়া? হয়তো না পাওয়ার মাঝেই আমার ভালবাসা। কখনো জানতে চেয়ো না কেন এতো কিছু পাবার পরও তোমাকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছি, শুধু যাবার বেলায় একটা কথাই বলে যাই, অনেক ভাল থেকো সুনীল, অনেক ভাল কাউকে খুঁজে নিয়ো নিজের জন্য, আর কখনো এই পাপীটার খোঁজ করো না। ইতি, তোমার পাপী সুবর্না।”


চা শেষ করে মেহেরপুরের উদ্দেশ্যে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সুনীল। হাতে তার পেট মোটা কাল ব্যাগ। কুকুরটি এখনো পেছন পেছন হাঁটছে, বিষণ্ণ মনে রাতের কালো আকাশ দেখছে সুনীল, কেন যেন মনে হচ্ছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এসে তার দু’গালের উপর পড়ছে, আকাশের দিকে গাড় দৃষ্টি দেয় সে, সেখানে কোন মেঘ নেই।


পুড়ে যাওয়া পা নিয়েই সে রাতেই জয়কে সাথে করে সুবার্নার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সুনীল। সুবর্নার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে সুনীল। জয় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছে সুবর্নার সাথে কথা বলতে। সুনীলের শরীর শীতে কাঁপছে, আজ এরচেয়েও বেশি কাঁপুনিতে কাঁপছে তার সমগ্র স্বত্তা। জয় নিচে নেমে আসে, ওর চেহারা মলিন। সুবর্না সম্পর্কে জানতে চাইলে ও কিছু না বলে শুধু বলেছে “চল সুনীল, বাড়ি চল।”


দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকে সুনীল। আলো বাতাস না এসে এসে ঘরের দেয়াল, মেঝে সব স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে।  ঘরের কোণে একটা সোডিয়াম বাতি জ্বলছে। বাতিটির আলোতে ঘরের ভেতোরটা কিঞ্চিৎ আলোকিত হলেও সিংহভাগই অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা সুবর্নার দেওয়া নীল রঙের সেই গিটার, যেটা দিয়ে সুনীল হাজারো গান শুনিয়েছে সুবর্নাকে। গিটারটির ঠিক উপরেই  পুরোটা দেয়াল আবৃত করে রাখা সুবর্নার নীল রঙের শাড়ি পরিহিত ছবি দিয়ে। ছবিটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সুনীল। কালো পেট মোটা ব্যাগ থেকে জন্মদিনের একটি কেক বের করে ছবিটির সামনে রেখে বলে-

“সুবর্না, শুভ জন্মদিন। ২৬তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিয়ো, জানি ভাল আছো তুমি চার দেয়ালের ছোট্ট সেই ঘরে। আমাকে কেন বললে না যাওয়ার বেলায়? আমিও না হয় যেতাম তোমার সাথে। তোমার জল ছলছল চোখের অন্তরালে কি লুকিয়েছিলো, তা জানতে আমার বেশি সময় লাগে নি। তুমি কি ভেবেছো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি তোমাকে ভুল বুঝবো? আরে বোকা মেয়ে, সবই আমার জানা ছিলো। তাইতো এতো রাতেও তোমার বাসায় ছুটে গিয়েছিলাম। একটাই আফসোস থেকে গেলো, শেষ বেলায় তোমার হাতটি ধরতে পাড়ি নি। আমাকে নিয়ে ভেবো না সুবর্না, আমি বেশ ভাল আছি, তোমার শেষ কথামতো অনেক ভাল একজনকে খুঁজে নিয়েছি, যার সাথে কাটিয়েছি জীবনের সব চেয়ে কষ্টের সময়গুলো, সে হলো তোমার কায়া। জীবনের ২৬তম জন্মদিনে তোমার কাছে একটাই আবদার, বাকী সবকটা জন্মদিনও আমার সাথে কাঁটাতে হবে, কি পারবে তো? আমি ঠিক এইভাবে প্রতিটা জন্মদিনে তোমার জন্য কেক নিয়ে আসবো, তোমাকে খাইয়ে দিবো নিজ হাতে।”

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কুকুরটি এখনো বাসার সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।

''একটা সময় ছিল ''

একটা সময় ছিল যখন 
আমি গাইতাম-
তুমি অবাক হয়ে শুনতে, 
আমি জানতাম গানগুলো 
আমার তখনও ছিল- 
এখনকার মতই নুনতে। 

একটা সময় ছিল যখন 
কথার ছিল না শেষ, 
হঠাৎ এই অবেলায় এসে 
কেটে গেলো সব রেশ,
তুমি ভীষণ ব্যস্ত আর
আমিও আছি বেশ।