শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২

“ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে”


আমি পরিবারের সব চেয়ে ছোট মেয়ে। আর সব চেয়ে ছোট বলে আদরটা সব সময় একটু বেশিই পেতাম। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিল স্নো-হোয়াইট, বাংলায় শব্দান্তর করলে দাঁড়াবে বরফ-সাদা বা সাদা-বরফ। বাংলায় শব্দান্তর করার কথার পেছনে কারনও অবশ্য আছে। বন্ধুরা আমাকে “সার” বলে ডাকতো। “সা” এসেছে সাদা থেকে আর “র” এসেছে বরফ থেকে। আমার অন্য আরেকটি পাঠ্যগত নাম ছিল, তা হলো – “স্নিগ্ধা”, নামটা আমার অনেক পছন্দের হওয়া সত্ত্বেও কেউই এই নামে ডাকে না। আর এটা নিয়ে আমার দুঃখের শেষ ছিল না। আমাদের পরিবারে আরো দুইজন মেয়ে আছে। একজন আমার লক্ষ্মী বড় আপু। আরেকটা হল আমার বজ্জাত মেজদি। আমার কোন কথা শুনে না, বরং সারাদিন আমার নামে বাবা-মার কাছে নালিশ দিয়ে বেড়ায়। বজ্জাত একটা। আর আমার বড় আপুটা কত্ত ভাল। কখনো আমাকে বকা পর্যন্ত দেয় না। আমাদের পরিবারের আরো একটা সদস্য আছে, যার সাথে পরিচয় না করিয়ে দিলে পরিচয় পর্বটাই যে বৃথা যাবে, সেই সদস্যটা হলো আমার নাদুশ-নুদুশ টেডি বেয়ার। একদম গুলুগুলু। দেখলেই গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে। ওর নাম হচ্ছে প্রিঞ্চ। প্রিঞ্চ কেন রাখা হয়েছে কেউ কি ধারণা করতে পারছেন? প্রিঞ্চ রাখা হয়েছে, কারন হল স্নো-হোয়াইটের যে প্রিয়তম ছিল, তার নাম ছিল প্রিঞ্চ।



আজ আমার বড় আপুর বিয়ে। বাড়িঘর অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। লাল বেনারসিতে বড় আপুকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আমারও আজ কেন যেন খুব বউ বউ সাঁজতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি আর মেজদি আজ পাল্লা দিয়ে সেজেছি।মেজদি জিজ্ঞেস করলো, কিরে তোকে এত সুন্দর লাগছে কেন রে? আমাকেও তো হার মানিয়ে ফেললিরে তোর রূপের ঝলকানিতে। হেহেহে, তুমি কি আর আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে? বলো? বাবা-মা তো আর অযথায় নাম স্নো-হোয়াইট রাখে নি। বলেই খেক খেক করে হেসে দিলাম।


সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে অনেক হৈচৈ বেঁধে গেলো। না না ভয়ের কিছু না। মেয়ে বিদায় পর্ব চলছে আরকি। বাবা-মা কাঁদছে, ঐ দিকে আপুও কাঁদছে। সব মিলিয়ে বেশ কান্নার হাটের মত বসে গেল। বুঝি না, কেন মানুষজন এত কান্নাকাটি করে। আমার বিয়ে হলেও কি আমি ঠিক এইভাবে কাঁদবো? কি জানি!


মেজদির বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেল। ছেলে বাইরে থাকে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। ছেলের আব্বু আবার বাবার পরিচিত, তাই হুট-হাট করেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হল। এইবার কিন্তু আর কান্নার হাট বসে নি, কারনটা কি কেউ আন্দাজ করতে পারছেন? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এইবার তো আর মেজদিকে আমাদের বাসা ছেঁড়ে চলে যেতে হয় নি। তো কাঁদবেই বা কেন? হেহেহে।



অসহ্য!! অসহ্য!! অসহ্য!! অনেকদিন পর বাসায় আসছি, কোথায় বাবা-মা খুশি হবে, তা না। ইনারা লেগে আছে আমাকে পাত্র দেখানোর পাল্লায়। আমি তো সাফ না করে দিয়েছি। এমনিতেই সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, তার উপর ভার্সিটির হলে পড়ালেখার ‘প’ ও হয় না। এই পরিস্থিতিতে কোথায় একটু শান্তিতে ঘুমাবো, তা না। পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেল। সন্ধ্যায় নাকি ছেলের পক্ষ আসবে আমাকে দেখতে। কি যে মেজাজ গরম হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। মেজাজ ঠাণ্ডা করার জন্য দিলাম এক ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো মেজদির ডাকে। - উঠ সারের বাচ্চা!! [ সার, স্যার ভেবে বসে থাকবেন না যেন ] ছেলের বাবা-মা তো এসে পড়েছে। - কি হইছে মেজদি? - আরে জলদি উঠ, ছেলে পক্ষ তো চলে আসছে তোকে দেখতে, তারাতারি কর। - আমি উঠবো না। - শোন, আমার লক্ষ্মী বোন, এখন পাগলামি করিস না। প্লীজ তারাতারি কর। অনেক আকুতি-মিনুতি করার পরও পারলাম না ঐ বজ্জাতটার সাথে। উঠে রেডি হতে বাধ্য হলাম। আপনারা ভাবছেন, কি যেন কি সেজে-গুজে গিয়েছি! তাই না? আপনারা যা ভাবছেন, তা ঠিক না। আমি মোটেও সাঁজ-গোঁজ করেনি। এমনকি আমার নামের অমর্যাদা করে স্নো পর্যন্ত মুখে না লাগিয়েই চলে গেলাম। কি ভাবছেন? ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে? তা তো জানি না, তবে ছেলের বাবা-মায়ের যে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে, তা তাদের তাড়া দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। তারা পারলে আগামীকালই আমাদের বিয়ের তারিখ ফেলে দেন।


আজ ছেলেটার সাথে আমার কাবিন হচ্ছে। ছেলেটার পরিবার সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তা হলো, ছেলেরা দুই ভাই। কোন বোন নেই, আর এই জন্যই বাবা-মার ছেলের বউ পেতে এত তাড়া। যার সাথে আজ আমার কাবিন হচ্ছে, তার নাম ইফাদ, যদিও স্বামীর নাম মুখে নেওয়া ভাল না, কিন্তু আমি তো নিতে পারি, ঐ ছেমড়া তো এখনো আমার স্বামী হয় নাই। হেহেহে। ছেমড়া তো বুঝতেছে না, কারে বিয়া করতাছে। পরে টের পাবে কত ধানে কত চাল। ছেলে নাকি ডাক্তার। দেখে অবশ্য আমার তাই মনে হয়েছিল। দেখতে শুনতে মোটেও খারাপ না। যে কোন মেয়ে খুব সহজেই পটে যাবে। ওর ছোট ভাইটার নাম সিজান। ছেলেটা এত্ত সুইট কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাসে অটেস্টিক হয়ে জন্মাতে হয়েছে তাকে। বাবা-মার সবচেয়ে আদরের ছেলে এই সিজানই। আমার জনের কোন দামই নাই। “আমার জন” কি বলতেছি আমি এই সব!!?? আজ কাবিন হওয়ার কথা না। আমাদের ধুম-ধাম করে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মরার পরীক্ষাই তো সব গণ্ডগোল বাঁধাইলো। এই পরীক্ষা কখনই আমার পিছু ছাড়বে না। কোথায় এখন একটু ভাল ভাবে ঘুরাঘুরি করবো, কক্সবাজার যাবো, সেন্টমার্টিন যাবো, তা না পরীক্ষা চলে এসেছে সামনে। পরিক্ষার কারনেই বিয়ের তারিখটা পিছানো হয়েছে। আমার খুব সখ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করা। কিন্তু এই মরার পরীক্ষাই সব খাইলো। মানুষের বিয়ে কি দশ বার হয়? পরীক্ষা তাও বুঝে না। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে পরীক্ষা হবে। বিয়ের তারিখ ফালানো হয়েছে ১লা মার্চ। এই নিয়ে আমার দুঃখের কোন কমতিই রইলো না। আমার উনি আবার এর মধ্যে আমাকে সান্ত্বনাও দিতে শিখে গেছেন! উনার অগ্রগতিতে আমি সত্যিই মুগ্ধ। আজ নাকি আবার আবাদার করে বসে, আমার সাথেই থেকে যাবে!!?? কি ভাবছেন? আবদার করেছিল? হ্যাঁ, একদম ঠিক ভেবেছন, ঐ ছেমড়া কিভাবে যেন বাবা-মাকে ম্যানেজ করে ফেলছে, আজ রাতে আমাদের বাসাতেই থাকবে। আজ নাকি আমাদের বাসর রাত!!! আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বুঝার চেষ্টা করলাম, সত্যি কি আমি জেগে আছি? নাকি ঘোড়ের মধ্যে ভাবছি? একটা চিমটি কাটলাম। আরে হ্যাঁ, আমি তো জেগেই আছি। মানে আজই আমাদের বাসর রাত!!


আমি বিছানায় বসে আছি। এই রাতকে নিয়ে প্রত্যেক মেয়েরই অনেক ধরনের আশা-স্বপ্ন থাকে। আমারও কি কোন আশা বা স্বপ্ন আছে? খুব দ্রুত ভাবতে লাগলাম। না, খুঁজে পেলাম না। হয়তো আমার আকাঙ্খা এত ছিল না, যতটা পেয়ে গেছি। মানুষ যখন তার চাওয়ার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়, তখন আর তার কোন আশা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ঐ ছেমড়া ঘরে ঢুকছে। আমার শরীর কেন যেন কাঁপতে শুরু করেছে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? ভয় পেলেই বা কিসের ভয়? নিজেকে শান্ত করলাম। ছেমড়াটা আমার পাশে এসে বসলো আর অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো!!! শুনতে চান কি কাণ্ড? আপনি যা ভাবছেন, তা না। ছেমড়াটা আমার হাত, তার হাতের উপর রেখে বেসুরা কন্ঠে গান গাইতে শুরু করলো, আমি হাসবো কিনা কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ গান বন্ধ করে আমার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল- “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে” আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ঐ পাগলটার দিকে।



পরীক্ষা শেষ। বাসায় আসছি গতকাল রাতের ট্রেনে। আজ ঐ ছেমড়াটার সাথে কার্ড সিলেক্ট করতে যাওয়ার কথা। কিসের কার্ড ভাবছেন তো? আরে আমাদের বিয়ের কার্ড। আরে “আমাদের” কথাটা কোত্থেকে আসলো?? 


কার্ডের দোকানে গিয়ে ঐ ছেমড়ার সাথে আমার তুমুল এক ঝগড়া হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দোকানের বয়স্ক মালিকটি ঠান্ডা লাচ্চি এনে আমাদের খেতে দিলেন, আর বললেন- বাবারা এই ভাবে ঝগড়া করা কি ঠিক? আপনারা ভাবছেন, আমরা কি নিয়ে এত ঝগড়া করছি? কি বুঝতে পারেন নি? আমাদের বিয়ের কার্ডটি দেখতে কেমন হবে, তা ঠিক করতে গিয়ে। ওর  সাথে আমার রুচির এত অমিল!!! জানলে ওকে বিয়ে করার চিন্তাই করতাম না। ও তো আমার মেজদির চেয়ে হাজারগুণ বেশি বজ্জাত। রাগে গা কটমট করছে। অনেক কষ্টে একটা কার্ড ঠিক করলাম দুইজন মিলে।



পরশু আমাদের বিয়ে আর আজ ঐ বজ্জাত ছেমড়াটা কক্সবাজার গেছে, যাবার আগে বলে গেছে আমার জন্য নাকি সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে। হাইরে বোকা বজ্জাত ছেমড়া, সারপ্রাইজের কথা আগে থেকে বলে দিলে কি আর তা সারপ্রাইজ থাকে? বোকা একটা, কিচ্ছু বুঝে না। হঠাৎ করেই মাঝ রাতের দিকে ফোন বেজে উঠলো, এত রাতে ফোন আসায় খুবই বিরক্ত হলাম। তারপরও ইমারজেঞ্চি কল ভেবে ফোনটা ধরলাম। কি ভাবছেন? আঁতকে উঠেছিলাম? না, আমি আঁতকে উঠি নি, আমি দৃঢ় ছিলাম। তেমন কিছুই তো ওর হয় নি, ছোট খাট একটা দুর্ঘটনা। রাতের অন্ধকারে প্রাইভেট কারটাকে ঘোড়াতে গিয়েই ছোট একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ডাক্তার বলল তো, তেমন কিছুই হয় নি। আমিও জানি আমার বজ্জাত বোকা ছেমড়াটার কিছুই হবে না। আমার নাম্বারটা নাকি ডায়েল কলে ছিল আমার বোকাটার মোবাইলে। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।


আমার পাশেই আমার পাগল বজ্জাত বোকা ছেমড়াটা শুয়ে আছে। ওর মুখটা কেমন যেন নীলাভ লাল হয়ে আছে। আর তার পাশেই রাখা আছে আমার জন্য আনা সারপ্রাইজটা, আমি দ্রুত খুলে দেখলাম কি সেই সারপ্রাইজ। খুলতেই দেখলাম পাথুরে শামুক দিয়ে খুদায় করা একটা পেইন্টিং। আর তাতে লেখা “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে” আমার আর বাকি কোন কিছুই মনে নেই।



আপনারা ভাবছেন আমি এখন কি করি? হেহেহে, আপনারা সবাই এত বোকা কেনো? আমি তো আর এই আবদ্ধ জেলখানা টাইপের ঘর থেকে বের হয়ে মন্দির বানাতে পারছি না, তাই আমার খাবার না খেয়ে জমিয়ে জমিয়ে মন্দির বানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু বজ্জাত লোক এসে মন্দির গুলো ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আমার না তখন ভীষণ কান্না আসে। আমার পাগল ছেমড়াটা না আমাকে বলেছিল ভালবেসে তার নামটি নিভৃতে লিখে রাখতে আমার মনেরও মন্দিরে। আমার মন্দির তো ঐ বজ্জাত লোক গুলো ভেঙ্গে ফেলে গো। আমি না তোমার কথা রাখতে পারছি না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন