রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১১

এতটুকোও মূল্য দিতে পারছি কি?


বাসা থেকে বের হতেই দেখা হয়ে গেল প্রবাসী এক দম্পতির সাথে।দেশে এসেছে,এখানেই স্থায়ীভাবে থাকার বন্দোবস্ত করছে।ফুটফুটে একটা সন্তান কোলে নিয়ে হাঁটছে  জুলি ভাবি।লাল শাড়ি পরিহিত অবস্থায় তাকে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না যে,এই হচ্ছে সেই জুলি ভাবি যে কিনা তার সমস্ত স্বাদ-আলহাদ,পরিবার,জাতীয়তা,ধর্ম সব ত্যাগ করে এক ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে শুধু মাত্র তার ভালবাসার মানুষটির উপর তার প্রগাড় ভালবাসা আর বিশ্বাসের কারনে।তার মধ্যে নেই কোন সংকোচ,নেই কোন হাহাকার।শুধু মাত্র নিজের ভালবাসার উপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকলেই এমন অটল চিত্তের অধিকারিণী হওয়া যায়।হাসি মুখে বিদায় দিলাম তাদের আর বললাম কখনো অবসর পেলে আমার গরীবখানায় এসে একবার দেখা করে যেতে।বলে আমি আমার কাজের উদ্দেশ্যে রউনা হলাম।

কিছু দিন পর,ভর দুপুর বেলা,আনুমানিক ৩-৩.৩০ নাগাদ কলিংবেলের আওয়াযে ঘুম ভাঙল।আমি একা মানুষ।এই দুপুর বেলায় কে আসলো!!!!অবাক হলাম !আর তাছাড়া ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে হবে বলে একটু বিরক্ত হলাম বটে।যাই হোক,সব বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দরজা খুললাম।খুলেই আশ্চর্য হলাম!!!!একি,হাসান ভাই যে,সাথে তার ফুটফুটে বাচ্চা আর ভাবিও আছেন।উনাদের দেখেই খুখে হাসি চলে আসলো।এমনিতেই একা মানুষ।পরিবার পরিজন বলতে এক দূর সম্পর্কের চাচা আছেন।তাও আবার গ্রামে থাকেন।কখনো সময় করে আমাকে দেখতেও আসা হয় না।তাই খুশির মাত্রাটা একটু বেশিই হল উনাদের দেখে।ভেতরে এনে বসালাম উনাদের।হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি বাবুটা আমার ডাইরী নিয়ে নাড়াচাড়া করছে,আর ভাবি তা দেখছেন।
-শোনলাম ভাবি নাকি বাংলা শিখছেন,কতটুকু আয়ত্ত করতে পারলেন?
-এই তো কিছু দিন হল মাত্র শিখা শুরু করলাম।হয়তো শিখে ফেলবো খুব শীঘ্রই। (নুতুন নুতুন ভাষা শিখছেন,তাই শুনতে একটু অদ্ভুত লাগছিল)
-হা,তাই যেন হয়।আচ্ছা আপনি আইরিশ হয়ে বাংলা ভাষা শিখতে কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো?
-না,তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না,তবে উচ্চারণে একটু অসুবিধে হয়।এই আর কি।
-ভাবি আপনি কি জানেন,ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষার স্থান ৫ম???
-তাই নাকি?জানতাম নাতো।এই তুমি না এত বড় সাংবাদিক! আমাকে তো কখনো তোমাদের ভাষা সম্পর্কে বল নি।
( আপনাদেরকে বলে রাখা ভাল যে,হাসান ভাই দেশ বরেণ্য সাংবাদিক।তার প্রচারিত  একটি প্রতিবেদন এক বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে সাড়া ফেলে দেয়।খুবই গুনি বেক্তিত্ব উনি )
-ভাবি ভাইয়ের উপর রাগ করবেন না।ভাই ব্যাস্ত থাকেন।তাই হয়তো বলার সুযোগ হয়ে উঠে নি।আজ আপনি একদম ঠিক জায়গায় এসেছেন,আপনাকে আজ আমাদের দেশের ভাষা সম্পর্কে কিছু বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে বেশ ধন্য মনে হচ্ছে।আপনি জানেন বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৬৮২ কোটি ৯৪ লাখ। এরা প্রায় ৬ হাজার ভাষায় কথা বলে।এদের মধ্যে বাংলা ৫ম।আর বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ হচ্ছে প্রায় ২৫ কোটি।
-তাই নাকি!তাহলে তো আমি এই ভাষায় কথা শিখছি বলে নিজেকে গর্বিত মনে করতে পারি। ( ভাবীর চোখে-মুখে বিস্ময় আর খুশির আবাস দেখা গেল )
-হা ভাবি,তাই।১৯৯৯ সালে প্রকাশিত The Summer Institute of Linguistics এর হিসেবে অনুয়ায়ী ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলার অবস্থান ৪র্থ।" শুধু বাংলাদেশের মানুষই যে এ ভাষায় কথা বলে তা নয় বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুর, মণিপুর,বিহার ও উড়িষ্যা এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গারাও বাংলা ভাষায় কথা বলে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে ২য় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে সেদেশের জনগণ বাংলাভাষা শিক্ষা করছে।
এই কথা শোনার পর ভাবির চোখ ছলছল করে উঠলো।ভাবী বলে উঠলেন
-এই তুমি কি বলতো,এতদিন আমাকে তোমাদের দেশের ভাষা সম্পর্কে কিছুই বললে না।যাও তোমার উপর রাগ করলাম।
একজন ভিনদেশি মানুষের আমাদের দেশের ভাষা,বাংলা ভাষা সম্পর্কে এত আগ্রহ আর কৌতুহল দেখে আপ্লুত হলাম!মনে মনে ভাবলাম,আমরা এখন কোন পরিস্থিতিতে আছি?বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে বাঙালীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন,আমরা কি তার এতটুকোও মূল্য দিতে পারছি?
হাসান ভাই এবং ভাবিকে বিদায় দিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম নিজের জীবনে।প্রায়ই হাসান ভাইয়ের লিখা আর্টিকেল পড়ে ভাবতাম পৃথিবীতে উনাদের মতো মানুষের বড্ড অভাব।দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম আর এই ভেবে সান্ত্বনা পেতাম যে দেশে ভাল মানুষ এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায় নি।

আজ প্রায় পাঁচ বছর হল হাসান ভাই আর ভাবি এই দেশে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করেছেন।ভাবি এখন খুব ভাল বাংলা বলতে ও লিখতে পারেন।উনাদের ফুটফুটে বাচ্চাটা এখন স্কুলে যায়।গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে উনাদের বাসায়।ভাবির শাড়ি পড়া দেখলে কেউ বলতেই পারবে না যে উনি আইরিশ।ঠিক যেন অবিকল গ্রামের বউদের মতো গুছিয়ে শাড়ি পড়েন।আর উনার বাংলা বলা অনেকটা বাঙ্গালীদের মতই স্পষ্ট হয়ে এসেছে।

আমি ভেবে প্রায়ই অবাক হই,একটা মানুষ কি করে নিজের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে অচেনা এক দেশে পাড়ি জমায়?তাও একজন ভিনদেশেবাসীর সাথে।ভাবি আর চোখ ভিজে যায়।কতই না সুন্দর এই ভালবাসা!!উনারা শত বছর ঠিক এই ভাবেই ভালবাসার বাঁধনে বাঁধা থাকুক এই প্রার্থণা করি।কিন্তু ভাল মানুষ জন খুব বেশি দিন বাঁচার সুযোগ পায় না।হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনার স্পটেয় মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন বিশ্ববরেণ্য সাংবাদিক হাসান মাহমুদ।আর ভাবি জুলিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।পরদিন  হাসপাতালে ভাবি জুলিও উনার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

খুব সহজেই হারিয়ে গেল দুটি তরতাজা প্রাণ আর তাদের প্রগাড় ভালবাসা।যে জুলি কিনা তার সব ছেড়ে আমাদের এই মাতৃভূমিতে পা রাখলো,আমাদের দেশ আর মাতৃভাষাকে ভালবাসল,আমরা সেই জুলিকে ধরে রাখতে পারলাম না।আমাদের মতো অভাগা আর কেউ কি আছে!!!ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো।পানি মুছে ছুটলাম আমার ব্যাস্ত জীবনের গ্লানি টানতে।আর ঠিক এভাবেই হারিয়ে যায় আমাদের খুব প্রিয় আর কাছের মানুষগুলো।

উৎসর্গ-আশফাক মুনীর মিশুক,তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ