বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১২

অঝর শ্রাবণ


অঝর-শ্রাবণ.jpg         অঝর শ্রাবণ
       ক্ষণিকের আগুন্তক
         একজন লেখিকা
 






ভূমিকাঃ শুরুতেই বলে রাখা দরকার, আমরা দুজনই কম-বেশি লেখালেখি করি, তবে সেটা শুধুমাত্রই শখের বশে। আর এই বাড়ন্ত শখের বিস্তৃত বহিঃপ্রকাশ আট পর্বের “অঝর-শ্রাবণ” গল্পটি।

উৎসর্গঃ গল্পটি উৎসর্গ করছি সেইসব মানুষদের যারা ভালবাসায় বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন ভালবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়

অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(১ম পর্ব)...
                     
ǀǀঅঝরের ভুবনǀǀ

কাকের ডাক শুনে ঘুম ভাঙলে কতটা বিরক্তি লাগে, তা আমাকে না দেখলে কেউ বুঝবে না। শরীরের রক্তগুলো সব গরম হয়ে মাথার তালু ফেটে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইচ্ছে হচ্ছে, এক এক করে সবগুলো কাককে রিভালবার দিয়ে গুলি করে মারি। কিন্তু আফসোস, হাতের কাছে কোন রিভালবার নেই। যদিও বাবার কাছে রিভালবার আছে, কিন্তু তা ধরার সাহস আমার নাই। রিভালবার কিনতে হলে এখন এই সাত সকালে আরামবাগের চিপার গলিতে যেতে হবে। কিন্তু এত সকালে আরামবাগ যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আজকের মত আরামবাগ যাবার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল। তাই কাক গুলো আজকের মত বেঁচে গেলো। তবে আমি ঠিক করে ফেলেছি, যে করেই হোক একটা রিভালবার আমাকে যোগাড় করতেই হবে। 
প্রায় দেড় মাস হয় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছি। পুরো সপ্তাহ কলুর বলদের মত খাটুনি খেটে যেই ছুটির দিনটায় একটু আয়েশ করে ঘুমাবো ভাবি, ঠিক তখনই কাক মহাশয়দের সুকন্ঠী গান শুরু হয়ে যায়। তাদের আবার আমাকে ঘুমুতে দেখলে হিংসে হয়।
 

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে কিছু জরুরী ফাইল আওরাচ্ছি। হঠাৎই আম্মুর কন্ঠ শুনতে পেলাম।
 
- কিরে অঝর, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাচ্ছিস না যে?
 
- , হ্যাঁ তাই তো, খেয়াল ছিল না আম্মু।
 
- খেয়াল থাকে কোথায়? আরেক কাপ চা নিয়ে আসবো?
 
- না আম্মু থাক। খানিকটা খেয়েছি, আর খাবো না।
 
- , তাহলে ঠিক আছে। আচ্ছা শোন, কাল যে মেয়ে দেখতে যাবার কথা, মনে আছে?
 
- উহু, মনে ছিল না।
 
- আচ্ছা ব্যাপার না, এখন মনে রাখলেই হবে। আমি যাচ্ছি, কিছুক্ষণ পর খেতে ডাকলে চলে আসবি কিন্তু।
 
- আচ্ছা আম্মু।
 

আমার ভাবতেই কেমন যেন অবাক লাগছে, আগামীকাল আমি মেয়ে দেখতে যাবো, তাও প্রথমবারের মত। মেয়ে দেখা ব্যাপারটা আমার আবার পছন্দের না। কেমন যেন সনাতনধর্মী ব্যাপার। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। শুনেছি বাবার পরিচিত এক বন্ধুর মেয়ে, নাম খুব সম্ভবত শ্রাবণ
বাবার মুখের উপর আমি কখনই না করতে পারি না, মানে সাহসে কুলোয় না। আদৌ কুলবে কিনা সন্দেহ। অনেকটা দাপটের সাথেই বাবা তার চাকরী জীবন শেষ করেছেন। মেজর জেনারেল ওয়াহিদ সাবেব বললে এখনো আর্মি সিভিলিয়ানরা সম্মানের সাথে ট্রিট করে। একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবার কোন কথা অমান্য করার সাহস হয় না, পাছে বাবা নিজের সম্মান হারান, তাই ছোট বেলা হতেই বাবার সকল আদেশ-উপদেশ এক মনে পালন করে আসছি। আজ এত বড় হবার পরও কোন ব্যতিক্রম হয় নি। জীবনের প্রথমবার কোন মেয়ে দেখতে যাবো বলে একেবারেই যে একসাইটেড ছিলাম না, তা কিন্তু না 

বেশ কিছু দিন আগে বাইরে একটা জবের জন্য আবেদন করেছি। অগ্রগতি বলতে বেশ ভালই এগিয়ে গেছে। আজ একবার ভিসা অফিসে গিয়ে দেখে আসতে হবে। বিকেলে টি.এস.সি তে বন্ধুদের আড্ডায় সঙ্গী হতে হবে। সে দিন তো হিমেল মুখের উপর বলেই দিল- দোস্ত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ঢুকার পর তো আমাদেরকে একদম ভুলেই গেলি, এই কি তোর বন্ধুত্ব? তুই জানিস না। তোকে ছাড়া আমাদের আড্ডা একদমই জমে না।
ভিসা অফিসে আজ আর যাওয়া হল না, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই টি.এস.সি এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গান আর জম্পেশ আড্ডায় হারিয়ে গেলাম কিছু মুহূর্তের জন্য। মাঝে মাঝে মনে হয়, বন্ধুরা ছাড়া পৃথিবীটা সত্যিই অনেক একা, অনেক বেশি একা।
 
ভালবাসা ব্যাপারটা নিয়ে আমার অনেক অনীহা আছে, আমার কাছে ভালবাসা মানে বাবা-মার আদর আর স্নেহ। আর বাদ-বাকি কোন কিছুই ভালবাসা নয়। ভালবাসা স্বর্গীয় বিষয়, আমাদের মত সাধারন মানুষের সাধ্যের বাইরে।
একবার হিমেল কোন এক মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে গিফট কিনার জন্য, ওর অনেক সখের গিটার বেঁচে দিয়েছিল। কই, মেয়েটাতো দিব্যি খুশি মনে তা নিয়ে নিলো, একবারও তো জিজ্ঞেসও করলো না, টিউশনি না থাকা সত্ত্বেও এত দামী উপহার কি করে দিল। হায়রে মেয়ে মানুষ!!!
 

রাতে বাসায় ফিরে আমার পিচ্চিকালের প্রথম এবং শেষ লেখা ডায়রির পাতা থেকে কিছু অংশ পড়ছিলাম। সময় হলেই কিছু কিছু অংশ পড়া হয়, আজ একদম প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করলাম-
 

আমার নাম অঝর। অঝর নামটা অনেক সুন্দর, আমার বন্ধুরা বলে। বাবা-মা অনেক আদর করে আমাকে অঝর সোনা বা অঝর বাবা ডাকে, আমার বেশ ভালই লাগে। আমি এখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটি আজকেও আমাকে একটা লাল গোলাপ দিয়েছে স্কুলে যাবার সময়। এই নিয়ে মেয়েটি আমাকে ৩৬টি গোলাপ দিয়েছে। আমি সব গুলো আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি। আর এর জন্য আম্মুর কাছ থেকে কত কথা শুনতে হয়েছে। আম্মু বলেছে- সুন্দর ছেলেদেরকে মেয়েরা ফুল দিবেই, খবরদার তুই কিন্ত ঐ মেয়ের সাথে কথা বলবি না, নইলে বাবার কাছে নালিশ করে দিবো।আমি নালিশের ভয়ে কখনই মেয়েটির সাথে কথা বলি নি। আজও না.........

হাসি মুখে ডায়রিটা রেখে ঘুমুতে গেলাম। কাল যে মেয়ে দেখতে যেতে হবে মনেই ছিল না।
 

আম্মুর বকুনিতে ঘুম ভাঙল। বাবা উঠে রেডি হয়ে গেছে, আর আমি কেন নবাবজাদার মত ঘুমুচ্ছি? এর জন্য আম্মুর বকুনির ইয়াত্তা রইল না। তরিঘড়ি করে একটা কাল শার্ট আর একটা প্যান্ট গায়ে লাগিয়েই বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবতেই বিস্মিত হচ্ছি, আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি তাও আবার নিজের বিয়ের জন্য।







অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(১ম পর্ব)...
                     
ǀǀশ্রাবণের ভুবনǀǀ 

মি শ্রাবণ। আমার নামটা অনেক সুন্দর, তাই না? নামটা রেখেছিলেন আমার আব্বু। ভেবেছিলেন এই নামের মতই তার মেয়েটাও খুব সুন্দর হবে। নাহ, সেটা হয় নি। সুন্দরী বলতে যা বুঝায় আমি তা নই। আমার গায়ের রং চাপা, নাকটা কেমন যেন থ্যাবড়ানো, আয়নার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই নাকটা চেপে চিকন করতে চেষ্টা করি! কিন্তু সেটা কি কখনো সম্ভব!

তবে আমার চোখদুটো বেশ সুন্দর, টানা টানা, অনেকটা দেবী দুর্গার চোখের মতো। তবে আমার গায়ের রঙের কাছে সেটা কখনই প্রাধান্য পায় না। মাঝে মাঝে পাত্রপক্ষ আমাকে যখন দেখতে আসে তখন আমার গায়ের রং দেখেই তারা না করে দেয়। কোন ছেলে বলে না যে এই মেয়ের চোখদুটো তো অসম্ভব সুন্দর! আমি একেই বিয়ে করবো।

আজকাল আর এসব ব্যাপার আমাকে তেমন বিরক্ত করে না। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। কিন্তু মানিয়ে নিয়েছি এখন। তবে আমার পরিবারের কেউ এখনও ব্যাপারটা ঠিকমতো মানতে পারে না। বিশেষ করে আম্মু তো ইদানীং আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। করবেই বা কিভাবে? আশেপাশের মানুষজন নানা রকম কথা বলে আমাকে নিয়ে। কিছু কিছু অবশ্য আমার কানেও এসেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, আমার নাকি কোনদিন বিয়েই হবে না। আমি নাকি এভাবেই আব্বু-আম্মুর ঘাড়ে চেপে বসে থাকবো সারাজীবন। এসব কথা শুনেছি রোদেলার কাছ থেকে। ওর এক বান্ধবী আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। তার মা নাকি প্রায়ই আমার সম্পর্কে এসব কথা বলেন। কথাগুলো শুনে তেমন কোন ভাবান্তর হয় না আমার। কচু পাতার পানির মতো ওসব আর এখন গায়ে লাগে না।

রোদেলার কথা বলি। রোদেলা আমার ছোট বোন, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। আম্মুর ধারণা আমার নাম শ্রাবণ বলেই আমার গায়ের রঙ এমন হয়েছে। তাই তো ওর নাম রেখেছে রোদেলা, ঝলমলে একটা নাম। রোদেলা ওর নামের মতই সুন্দর, আর ভীষণ চটপটে একটা মেয়ে। কথা না বললে ওর পেটের ভাত হজম হয় না। সারাদিন কি করেছে, কি খেয়েছে, কোন ছেলে ওকে কি বলেছে সব কথা আমাকে ওর বলতে হবেই। রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পরবে, নিজেই জানবে না।

এই মুহূর্তে, বিশেষ কোন কারনে, রোদেলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছু বলবি?”
আম্মু তোমাকে গোসল করে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে বলেছে। ওরা চলে আসবে।
আচ্ছা।
আম্মু তোমাকে নীল জামদানীটা পরতে বলেছে।
আম্মুকে গিয়ে বল, অই জামদানীতে আমাকে শ্যাওড়াগাছের পেত্নীর মতো লাগে।
আপু, এসব বলবা না তো। এসব শুনলে আমার খুব খারাপ লাগে।
আচ্ছা, বলবো না। এবার খুশি?”
আপু, তাড়াতাড়ি রেডি হও তো। দেরি হলে আম্মু রাগ করবে।
হচ্ছি রে।

আজ আবার আমাকে কারা যেন দেখতে আসছে। আব্বুর পরিচিত কেউ হবে হয়তো। হিসেব মতে এরা হচ্ছেন ১১তম পাত্রপক্ষ! হুম, আগে আরও ১০জন আমাকে দেখে গিয়েছে। কেউ সরাসরি না করেছে, কেউ একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। কিন্তু সবার একই, “না।এরাও নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম কিছু বলবে না! আবার কতোগুলো মানুষের সামনে গিয়ে একটা পাথরের মতো বসে থাকা। এসব আর ভাল লাগে না। এমন করাটা কি খুব জরুরি! মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, নিজের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাই না। তখন তানপুরাটা নিয়ে বসি। সুরের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেই। কোনদিকে খেয়াল থাকে না। অনেক সময় তানপুরার তারে হাত কেটে যায়, তবুও থামি না।ধ্যাত, কি সব কথা শুরু করলাম! আমাকে তো এখন পুতুল সাজতে হবে। রং মেখে সং সেজে স্টেজে দাঁড়াতে হবে, প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

হালকা সবুজ জমিনের একটা শাড়ী বের করলাম। এটাই পরবো, পছন্দ করলে করুক, না করলে নেই। জানি আমাকে দেখই ছেলে না করে দিবে, তবুও আম্মু-আব্বুর মন রাখার জন্য এটুকু করতে আমার কোন সমস্যা নেই। চোখে বেশ গাঢ় করে কাজল লাগালাম, কপালে ছোট্ট একটা টিপ আঁকলাম, দুহাতে পরলাম সবুজ কাচের চুড়ি।

তোকে না বলেছিলাম নীল জামদানীটা পরতে, তুই এই মরা টাইপের শাড়ী কেন পরেছিস?”-আম্মু কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারি নি!
আমার এটা পরতে ইচ্ছা হচ্ছিল, তাই পরলাম।
যা ইচ্ছা হয় তাই কর।আম্মু কিছুটা রাগ হয়েই বের হয়ে গেল রুম থেকে।

আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ইশ, এখন যদি খুব জোরে বৃষ্টি হতো তাহলে এই দেখাদেখির পর্বটা ক্যান্সেল হয়ে যেতো। কিন্তু আকাশে মেঘের কোন চিহ্নই নেই। আমার একদম ভাল লাগছে না। নিজের জন্য খারাপ লাগে না, খারাপ লাগে আব্বু-আম্মুর জন্য। বারবার তাদের মলিন মুখটা দেখতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু যেটা এড়িয়ে যেতে চাই, সেটাই ঘটে আমার সাথে। এবারো নিশ্চয়ই তাই হবে! ধুর, এতো ভাবছি কেন? যা হওয়ার তাই হবে।

হঠাৎ করেই রোদেলা রুমে ঢুকে বলল আপু, ওরা চলে এসেছে।
নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে নিলাম। কাজলটা একদম ভাল না, ছড়িয়ে গিয়েছে...














অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(২য় পর্ব)...
               
ǀǀশ্রাবণ ধারায় নতুন ঝঙ্কারǀǀ 

মি এখন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছি। আম্মু নাস্তার ট্রে সাজাচ্ছে আর আমাকে সেই ট্রে নিয়ে ড্রইংরুমে যেতে হবে। এই কাজে আমি খুব পটু। এখন পর্যন্ত ১০ বার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে, তাই এখন আর হাত কাঁপে না। প্রথমবার তো ছেলের হাতের উপর গরম চা ফেলে দিয়েছিলাম। ছেলের মায়ের সে কি চিৎকার! কত কথাই না শুনিয়েছিল আমাকে। খুব কেঁদেছিলাম সেইদিন।

দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ট্রে-টা নিয়ে বাইরে যা। সাবধানে নিস কিন্তু, কোন কিছু ফেলবি না।আম্মু আমাকে সাবধান করে দিল।
ঠিক আছে।
মাথায় কাপড় দিস নাই কেন? আচ্ছা, তুই কি চাস বল তো? রোজ রোজ এসব করতে কি তোর খুব ভাল লাগে? একটুও খারাপ লাগে না?” বলতে বলতেই আম্মু হঠাৎ করে কেঁদে ফেললেন।
আমি ট্রে হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আম্মুর চোখটা মুছিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। আমি ট্রে-টা হাত থেকে নামিয়ে আম্মুর দিকে এগিয়ে যাবো, ঠিক তখনি রোদেলা এসে বলল, “আপু,আব্বু তোকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি চল। আর আম্মু তুমি কাঁদো কেন?” অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকায় সে
বেশি বকবক না করে আপুকে বাইরে নিয়ে যা তো।

ড্রইংরুমে চারজন মানুষ বসে আছেন। আব্বু এবং তার বন্ধু কোন একটা ব্যাপার নিয়ে জোরে জোরে হাসছেন। অন্যদিকের সোফায় বসেছেন তার স্ত্রী এবং তাদের ছেলে(মনে হয় এর জন্যই আমাকে দেখতে আসা হয়েছে।) আমি তাকেভালোমতো দেখতে পারছি না। সরাসরি তাকালে ব্যাপারটা খুব বাজে হয়ে যায়। তবে এটুকু বুঝতে পারছি যে সে আড়চোখে আমাকে দেখছে। মেয়েদের ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়। আর সেই ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের জোরেই বুঝতে পারলাম যে, শুধু ছেলেই নয়, ছেলের মা-ও আমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আমি ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখলাম।
ছেলের বাবা আমাকে খুব মিষ্টি করে বললেন, “বস মা।
আমি তারএকদম সামনাসামনি বসলাম। রোদেলা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, আম্মুও রুমে ঢুকল।
ছেলের মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “পড়ালেখা কতদূর করেছ? এখনও কর নাকি ছেড়ে দিয়েছ? অনেক মেয়ের তো আবার বিয়ের কথা শুনলে আর পড়ালেখা হয় না।

এমন কথা আমি আগেও অনেকবার শুনেছি, কিন্তু আজ যেন কথাটা একদম তীরের মতো এসে বিঁধল। আড়চোখে দেখবার চেষ্টা করলাম সেতার মায়ের এই কথায় সায় জানাচ্ছে কি না। তাকাতেই তার চোখে চোখ পড়ে গেল আর সেই চোখের দিকে তাকিয়েই কেন জানি আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আমি দেখলাম সে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কখনো এই দৃষ্টির সাথে পরিচিত ছিলাম না। কি দেখছে মানুষটা? খুব জানতে ইচ্ছা করছে।

আব্বু মুখ খুললেন, “ভাবী, শ্রাবণ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ছে।
তাই নাকি?” উনি কেমন যেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কথাটা বললেন।
পাশাপাশি ও অনেক ভাল গান করে।
ছেলের বাবা বললেন, “বলেছিলাম না, ও অনেক গুণী মেয়ে।
তুমি চুপ থাক তোমহিলা অনেকটা হুঙ্কার দিয়ে বললেন। ওসব গান গেয়ে কি এযুগে কোন লাভ আছে? সবার আগে প্রেসেন্টেবল হতে হয়। প্রেসেন্টেবল না হলে কোন গুণ-ই কোন কাজের না।
তার ইঙ্গিতটা কোন দিকে ছিল, সেটা বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হল না।
আহ, আম্মু! কি শুরু করলে এসব? থামো তো।এই প্রথম তার কণ্ঠ শুনলাম। আবার আড়চোখে তাকে দেখতে চেষ্টা করলাম। মনে হল সে তার মায়ের ব্যবহারে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে।

সবাই চুপ করে আছে, কে যে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আব্বু নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, “আপনারা তো কিছুই নিলেন না।
নাহ, ঠিক আছে। আমরা এখন উঠবো।এই বলেই ছেলের মা দাঁড়িয়ে গেলেন।

আমার কেন জানি খুব খারাপ লাগলো। আরেকটু সময় বসলে কি হতো? হয়তো সেআরও কিছু বলতো, আরেকবার তার কণ্ঠ শুনবার সুযোগ হতো। নিজের চিন্তাগুলো কেমন যেন অবাস্তব মনে হল। অপমানের কথা এক নিমিষেই কিভাবে ভুলে গেলাম?
আম্মু আমার কাছে এসে বলল ওনাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতে। ব্যাপারটা খুব বেশি ঠুনকো মনে হল। তবুও এগিয়ে গেলাম। ছেলের মায়ের পা স্পর্শ করার আগেই তিনি বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, সালাম করতে হবে না। আর একটা কথা, তোমাকে এই রঙের শাড়িতে একটু বেমানান লাগছে।
আমি এবার সরাসরি তারদিকে তাকালাম। সেমাথা নিচু করে আছে। আমার দিকে তাকানোর মতো সাহস হয়তো তারহচ্ছে না।

দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে একবার সেপিছন ফিরে তাকিয়েছিল, তাকিয়েছিল আমার চোখের দিকে। সে কি বুঝেছে আমার চোখের ভাষা, আমার চাপা কষ্টগুলো কি সে দেখেছে? কি সব ভাবছি আমি? চিনি না, জানি না একজন মানুষকে নিয়ে এতো কেন ভাবছি? এভাবে কেন ভাবছি?

ছাদে চলে গেলাম। আকাশটাকে লাল করে সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। আমারও ঐ সূর্যটার সাথে ডুবে যেতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু কি যেন একটা বারবার টানছিল পেছন দিকে, দূর থেকে ভেসে আসা একটি কণ্ঠ যেন আমাকে ডাকছিল। আমি অন্ধকারের মাঝেই ছাদে বসে রইলাম আরেকটিবার সেই অবাস্তব কণ্ঠ শুনবার আশায়।

রোদেলা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসে হাজির হল।
আপু তুমি এখানে? আমি সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজচ্ছি!
কেন, কি হয়েছে।
এই দেখ, অঝর ভাইয়া তার ওয়ালেট ফেলে গিয়েছেন।
অঝর ভাইয়া!বুঝলাম তার নাম অঝর।
রোদেলা বকবক করতে লাগলো, “আব্বুর কাছে এইমাত্র ওনার নাম শুনলাম। নামটা অনেক সুন্দর না? ইশ, তোমাদের বিয়ে হলে কি ভাল হতো। ওনার নাম অঝর, তোমার নাম শ্রাবণ। আর তোমাদের মেয়ে হলে ওর নাম রাখতে ধারা’... অঝর-শ্রাবণ-ধারা।
রোদেলা, প্লিজ চুপ কর তো। আমার খুব মাথা ধরেছে। তুই নিচে যা।

ওয়ালেটটা আমার হাতে দিয়ে রোদেলা চলে গেল। আমি জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। মনে একটা আশা জাগলো যে সে ওয়ালেটটা নিতে আসবে। আরেকটিবার তার দেখা পাবো। ওয়ালেটটা খুব যত্নের সাথে ড্রয়ারে রেখে দিলাম। আজ পর্যন্ত নিজের কোন জিনিসও মনে হয় এতো যত্ন করে রাখিনি। কেন জানি তার প্রতি অজানা একটা অনুভূতি কাজ করছে। সে কি ওয়ালেটটা নিতে আসবে

অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(২য় পর্ব)...
              
ǀǀঅঝরের ভুবনে নতুন সূর্যোদয়ǀǀ 

নেকটা আগ্রহ নিয়েই বসে আছি মেয়ে দেখবো বলে। বারান্দার দিকে চোখ যেতেই মনে হল, কেউ একজন বারান্দায় রাখা দোলনায় দোল খাচ্ছে। চুল গুলো দেখা যাচ্ছে দরজার ফাঁক দিয়ে। হঠাৎ করেই যেন নাই হয়ে গেল সে। চোখটা ওদিক থেকে সরিয়ে বারান্দার কোণে রাখা লাভ বার্ড গুলোর দিকে নিবন্ধন করলাম। পাখিগুলোকে কেন যেন একটু বেশিই ভাল লাগছিল দেখতে, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ পাখিগুলোর দিকে। এরপর চোখ গেল অন্যরুমে রাখা তানপুরার দিকে। ইচ্ছে হচ্ছিলো, আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করতে তানপুরা কে বাঁজায়কিন্তু করা হয়ে উঠলো না। 

মাথায় কাপড় আর হাতে ট্রে নিয়ে একটি মেয়ে ঘরে ঢুকলো। চোখে অনেক স্বপ্ন আর বাস্তবতার বেড়াজাল নিয়ে। আমার বুঝতে ভুল হল না যে, এই সেই মেয়ে যাকে দেখার জন্য আজ আমাদের এখানে আসা। আমি প্রথমে কিছুটা ইতস্তত হয়ে গুটিয়ে বসে রইলাম।
 
আমার মধ্যে কেন যেন একটু উত্তেজনা কাজ করছিল, যে কোন নতুন অভিজ্ঞতা মানুষের উত্তেজনা কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দেয়। বেশ জড়-সড় হয়ে বসে আছে মেয়েটি। মনে হচ্ছে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেঝের মধ্যে খুঁত বের করায় ব্যস্ত। কিছুটা আড়চোখেই তাকালাম ওর দিকে। কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে ওকে। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি ওকে বহুকাল ধরে চিনি। আমার মধ্যে মোটেও কবি সত্ত্বা নেই, আমি এই ধরনের কাব্যিক ভাবওয়ালা মানুষজন হতে একশ হাত দূরে থাকি সব সময়, কিন্তু ওকে দেখা মাত্রই বরি ঠাকুরের সেই চিরায়ত কিছু লাইন মাথায় ভনভন করতে লাগলো-
 

আমি চিনি গো চিনি তোমারে
 
ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে
 
ওগো বিদেশিনী॥
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে,
 
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি হৃদি-মাঝারে
 
ওগো বিদেশিনী।
আমি আকাশে পাতিয়া কান
 
শুনেছি শুনেছি তোমারি গান,
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ
 
ওগো বিদেশিনী।
ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি
 
এসেছি নূতন দেশে,
আমি অতিথি তোমারি দ্বারে
 
ওগো বিদেশিনী॥

ভাবনার রেশ কেটে গেল আম্মুর মুখে কিছু অবান্তর ধরনের প্রশ্ন শুনে। এই ব্যাপারটা আমার খুবই অপছন্দের। একটা মানুষকে উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন করার মানে কি? আমার নিজেরই খারাপ লাগছিল এই ধরনের প্রশ্ন শুনে। কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বারবার আম্মুকে এই ধরনের প্রশ্ন না করতে ইঙ্গিত করছিলাম। কিন্তু আম্মু আমার ইশারাকে কটাক্ষ করলেন না।
 

মেয়েটি সম্পর্কে কিছু বলে রাখা ভাল- দেখতে খুব একটা আহা মরি সুন্দরি না, গায়ের রঙ শ্যামলা থেকেও খানিকটা চাপা। তবে তার চোখ দেখে আমি সত্যি অপলক তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। মানুষের চোখ যে এত সুন্দর হতে পারে, তা এই মেয়েটার চোখ না দেখলে বুঝার সাধ্য নেই। এই চোখের ভিতর ডুব দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেকে ভিজিয়ে নিয়ে আসতে।

আচমকা মেয়েটি আমার দিকে তাকালো, খুবই ইতস্তত হয়ে আমি চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েও নিতে পারলাম না। সত্যিই আমি ওর চোখের গহীন অরণ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটির হাত ভরা কাচের চুড়ি, চুড়িগুলো যেন খুব আনন্দের সাথে ওর হাতে সেঁটে আছে। কিছুক্ষণ পরপর টুংটাং শব্দ করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তা দেখতে আমার মন্দ লাগছে না। মেয়েটাকে বেশ ভদ্র মনে হল আমার, মনে হল খুব বেশি রকম ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। যদি এমনটা নাই হত, তাহলে কেনই বা চোখে চোখ পরতেই তৎক্ষণাৎ তা সরিয়ে নেয়া?
 

আম্মুর কিছু অবান্তর প্রশ্ন শুনে আমার ভাবান্তর হল- কিছুটা রাগের মাথায় আম্মুকে বললাম-আহ, আম্মু! কি শুরু করলে এসব? থামো তো।
 
আম্মু এই বার আমার কথায় কটাক্ষ করলেন। মেয়ের বাবা আমাদের কিছু নিতে বললেন, কিন্তু আম্মু সেটা উপেক্ষা করে সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই বিব্রতকর মনে হল। নিজেকেই এই অবস্থার জন্য দোষারোপ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পরলাম। আম্মুর পেছন পেছন বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে, যাবার আগে মেয়েটার চোখে একবার তাকালাম, সে চোখে অনেক না বলা কথা জমা আছে। নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে হচ্ছিলো। ওর চোখ জলে টলমল করছে, আর পাশের রুম থেকে ওর মা এসে কি যেন চেঁচামেচি করছে। কখনো কোন মেয়েকে এইভাবে কাঁদতে দেখা হয় নি আমার।

আমি কাপুরুষ নই
আমি আমার জায়গাতে অনেকটা ঠিক আছি। আমি আম্মুর অবাধ্য হতে চাই নি, এতটুকোই যা। তবে মেয়েটির কষ্ট কিছুটা হলেও দূর করতে পারবো এই ভেবে জেনে শুনেই ওয়ালেটটা ফেলে এসেছি ওদের বাসায়। আম্মুর এই ধরনের আচরণের জন্য মেয়েটাকে অন্তত একবার সরি বলাটা বাঞ্ছনীয়। ওয়ালেটটা ফেলে আসার আগে কিছুটা ভয় কাজ করছিল, পাছে আম্মুর কাছ থেকে কিছু কথাও শুনতে হতে পারে। কোন কিছুর ইয়ত্তা না করেই মনের ডাকে সাড়া দিয়ে ফেলে রেখে আসলাম আমার অনেক পছন্দের ওয়ালেটটা। 

রাস্তায় মা বললেন, মেয়েকে তার একটুও পছন্দ হয় নি, ঐ ঘটনার পর এটা আমার বুঝতে বাকী ছিল না। এরপর কিভাবে বা কখন মেয়ের বাসায় তা বলা হবে, তা শোনার আর ইচ্ছে হচ্ছিল না। নিজেকে কিছুটা অপরাধী মনে হচ্ছিলো। এই অপরাধবোধ হতে যে করেই হোক মুক্তি পেতে হবে আমাকে, নইলে তা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। উদাস মনে গানের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে কারটা টান দিলাম।
 

বাসায় পৌঁছে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার লাভ বার্ডগুলোকে আদর করতে করতে কখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে টেরও পেলাম না। রাতের আকাশের তারা গুনতে গুনতে হিমেলের কথা ভাবতে লাগলাম, হিমেল কেন মেয়েটার জন্য তার এত সখের গিটার বেঁচে দিয়েছিল? মেয়েটাকি এখনো তার ভালবাসার মানুষ হয়েই আছে নাকি অন্য কারো জীবন আলোকিত করার জন্য হিমেলকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে গেছে? হিমেলকে একটা কল দিলে মন্দ হয় না, হাতে মোবাইল নিলাম হিমেলকে কল করার জন্য............













অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(৩য় পর্ব)...
                
ǀǀজ্যোৎস্নাস্নাত অঝর বর্ষণǀǀ 

ঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে আঁতকে উঠলাম, মনে হল আমার খুব কাছেই কোথাও বজ্রপাত হল। গাড়ি থেকে বের হতেই পুরো আকাশ জুড়ে বিস্তীর্ণ মেঘপুঞ্জ মালা চোখে এসে গ্রাস করলো। আমি কিছুটা সময়ের জন্য মন্ত্রমুগ্ধের মত আকাশ পানে তাকিয়ে রইলাম। কালো হয়ে আছে পুরো শহর। যানবাহন নেই বললেই চলে। ঢাকা শহরে একটু বৃষ্টিতেই রাস্থা-ঘাট সব পানিতে ডুবে যায়, তাই আর মানুষজনের ঘর থেকে বের হওয়া হয় না। কিছুটা নির্জনতা কাজ করছে চারপাশে। কিন্তু হঠাৎ আসা বজ্রপাতগুলো এই নির্জনতার রেশ কাটিয়ে তুলছে বারাবার। 

শ্রাবণদের বাসার দিকের রাস্তা হয়ে আজ বাসায় যাচ্ছি। সুযোগ হলে একবার কার থেকে নেমে শ্রাবণের সাথে দেখা করে যাবো। মেয়েটার সাথে হয়তো একটু বেশিই অন্যায় করা হয়ে গেছে। এসি বন্ধ করে দিয়ে কারের জানালাটা খুলে দিলাম। দমকা বাতাস এসে গায়ে লাগতেই সারা শরীর শিহরণ দিয়ে উঠছে, এই যেন এক অন্যরকম ভাললাগা। ভলিউম কমিয়ে দিয়ে রবিঠাকুরের একটা গান শুনতে শুনতে ছুটলাম শ্রাবণদের বাড়ির পানে-
 

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।।
ধরায় যখন দাও না ধরা
হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।।
তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে।
খেলার পুতুল ভেঙে গেছে প্রলয় ঝড়েতে।
থাক তবে সেই কেবল খেলা,
হোক-না এখন প্রাণের মেলা
তারের বীণা ভাঙল, হৃদয়-বীণার গাহি রে।।

বাসায় কলিংবেল দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলতে এলো রোদেলা। আঙ্কেল আন্টি কোন এক কাজে বাসার বাইরে। আমাকে সোফায় বসিয়ে রোদেলা পাশের রুমে চলে গেল। বাসায় ঢুকার পর থেকেই একটা শব্দ কানে এসে লাগছিল, নীরবতা সেই শব্দকে আরো স্পষ্ট করে তুলল
না, এটাকে শব্দ বলা যায় না, এটা কোন বাদ্যযন্ত্রের তোলা সুর। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছি আর মনে করার চেষ্টা করছি এটা কোন বাদ্যযন্ত্র। মাঝেমাঝে অনেক পরিচিত কিছু জিনিসও সহজে মনে পড়তে চায় না। 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। যে ঘর থেকে সুর ভেসে আসছিল, আমি সেই দিকে যাচ্ছি, কেমন যেন একটা ঘোরের মত অবস্থার শিকার হয়েছি। চেষ্টা করছি ঐদিকটায় না যেতে, কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার পাশে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কেউ একজন তানপুরা বাজাচ্ছে আপন মনে, মনে হচ্ছে তানপুরার সাথে তার কোন আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে শুধু মেয়টির চুল দেখা যাচ্ছে। ঘন কাল চুলগুলো কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আর জানালার ফাক দিয়ে দমকা হাওয়া এসে চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিলো না কোন শব্দ করতে, কারন আমার তানপুরার সুর অসম্ভব প্রিয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি গান ধরলো। সে এক ভুবনভোলানো সুর। আমি গানের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য-

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ ।
সে তো এল না যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ ।।
সে কি মোর তরে পথ চাহে, সে কি বিরহগীত গাহে
যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে আমি ত্যজিলাম গেহ ।।
 

হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা আমার জন্য কখনই সুখকর না। হারিয়ে যেতে যেতে দরজায় লাগানো উইন্ড চাইম এর উপর হাত পড়ে গেলো, আর সাথে সাথেই কানে আসা তানপুরা আর সুমিষ্ট কন্ঠ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। আমি আরেকবার তাকালাম দরজার ফাঁক দিয়ে। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খুবই বিব্রত হলাম, এই মেয়েটিই শ্রাবণ। আমাকে কি না কি মনে করছে, এই ভেবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। ড্রয়ারে কি যেন তড়িঘড়ি করে খুঁজতে লাগলো। এরপর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওয়ালেটটা বাড়িয়ে দিলো। আমি লজ্জিত হবো নাকি খুশি মনে ওয়ালেটটা নিবো, বুঝতে পারছিলাম না।
 
হয়তো নির্লজ্জের মতই হাত বাড়িয়ে ওয়ালেটটা নিলাম। ঠিক তখনই কেন যেন একটা বজ্রপাত হল আর বিদ্যুৎ চলে গেলো। মনে হচ্ছিলো, আমি যেন কোন মুভির নায়ক আর সে আমার নায়িকা। এই রকম সিনেমেটিক অবস্থায় এমনটা ভাবা দোষের নয়।
ঘরে আই.পি.এস. ছিল বলে বেঁচে গেলাম এবারের মত, নইলে কিছু ঘটেও যেতে পারতো। আমি বের হয়ে যেতে চাচ্ছি, কিন্তু শ্রাবণকে সরি না বলে বের হই কিভাবে? তাই অনেকটা অপরাধীর মত ভঙ্গীতে শ্রাবণকে বললাম,
 
আমি আমার আম্মু এবং পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কাল সকাল থেকেই আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ ছিল, তাই হয়তো আপনার সাথে কিছুটা মিসবিহেভ করেছে। এর জন্য আমি সত্যি খুব লজ্জিত।
 

শ্রাবণ ইতস্তত হয়ে বলল, “আরে কি বলছেন এই সব? আপনি এতটাও ফরমাল হবেন না। ঠিক আছে তো, আমি কিছু মনে করি নি


এখন আমার বিদায় নেওয়ার পালা, নইলে বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে, এমনিতেই আম্মুকে মিথ্যা অফিসের কাজের বাহানা দিয়ে আসতে হয়েছে। এরি মধ্যে চার বার ফোনও দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আসার সময় বাঁধ সাধলো রোদেলা, বলল ভাইয়া এখনই যাবেন না, বাইরে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, তাছাড়া আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছি, কিছুই না খাওয়ায়ে তো আর মেহমানকে যেতে দেওয়া যায় না
 

ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েই বসে থাকতে হলো, বাইরে ঝরের তাণ্ডবটা খানিকটা বেশিই। রোদেলা এসে পাশে বসলো, নানা বিষয় নিয়ে গল্প করছে ও। নিজেকে একটু একাই মনে হল এতদিন পর, রোদেলার মত ছোট একটা বোন থাকলে খারাপ হতো না।
 
কিছুক্ষণ পর রোদেলার ডাকে শ্রাবণ এসে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার কাছে।
 
কেন যেন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, শ্রাবণকে গান গাইতে বলার, কিন্তু সাহসে কুলালো না। চুপ চাপ বসে রইলাম প্রায় দেড় ঘন্টা। ঝর থামতেই বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
 

আজকের রাতের আকাশটা কেমন যেন উদাস উদাস। কিছুই ভাল লাগছে না। হিমেলকে আজ আরেকটা বার ফোন দিলাম, কালকের মত আজও ওর ফোন বন্ধ আসলো।
 

কিছুদিন পর কোন এক অফিসের কাজে ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই চোখে রোদেলাকে পড়লো। কার থেকে নেমে ওর দিকে এগিয়ে যেতেই শ্রাবণকে দেখতে পেলাম, লেকের স্বচ্ছ জলে বোটে করে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এক মনে গুন গুন করে যাচ্ছে। কেন যেন আজ লেকের পানিতে আমারও ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। রোদেলাকে সঙ্গী করে উঠে পরলাম বোটে। লেকের মাঝে শ্রাবণকে ঘুরতে দেখে, পেছন থেকে বোট নিয়ে বেশ জোরে-সোরে ধাক্কার মত দিলাম। আর ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই বেচারি রোদেলাকে শ্রাবণের কাছ থেকে কিছু কথা শুনতে হলো। এরপরের ঘটনা অনেকটা সাধারন। শ্রাবণের সাথে পাড়ে বোট ভিরালাম। পাশের এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে হালকা নাস্তা করে নিলাম এবং বোটের সাথে বোটের সংঘর্ষ করার জন্য দুষ্টামি করে মাফ চাইলাম। আর এই ভাবেই শুরু হয়ে গেল অঝর আর শ্রাবণের বন্ধুত্বের অধ্যায়।







অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(৩য় পর্ব)...
             
ǀǀ শ্রাবণ আকাশে একফালি রোদǀǀ   

কাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা-ঘাট সব পানির নিচে। রোদেলা তাই আজ কলেজে যায় নি। আব্বু-আম্মুও বাসায় নেই। গ্রামের বাড়িতে জমি-জমা নিয়ে কিছু ঝামেলা বেঁধেছে, তাই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই দুজন সাতসকাল বেলায় স্টেশনে ছুটেছেন। দুপুরের দিকে বৃষ্টিটা একটু কমে গেল। তবে আকাশ আগের মতই মুখ গোমড়া করে বসে রইল। আমি জানালাটা খুলে দিলাম, একটা ঠাণ্ডা প্রশান্তিতে যেন ঘরটা ভরে গেল। বৃষ্টি শেষের এই ভেজা পরিবেশটা আমার খুব পছন্দের। ভেজা মাটির ঘ্রাণ, ঠাণ্ডা বাতাস, গাছের পাতা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পরা জলকণা, সবকিছু মিলে চমৎকার একটি পরিবেশ।

আমি তানপুরাটা হাতে নিলাম। এমন পরিবেশে আমার গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছা করে। আর আজকের পরিবেশটা একটু বেশিই চমৎকার। তানপুরার তারের উপর ধীরে ধীরে আমার আঙ্গুল চলতে লাগলো। আমি গাইতে শুরু করলাম...

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ ।
সে তো এল না যারে সঁপিলাম এই প্রাণ মন দেহ ।।
সে কি মোর তরে পথ চাহে, সে কি বিরহগীত গাহে
যার বাঁশরিধ্বনি শুনিয়ে আমি ত্যজিলাম গেহ ।। 
রবিঠাকুরের এই গানটা আমার খুব প্রিয়। গত বিকাল থেকে বারবার এই গানটিই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে তানপুরার সুরের সাথে নিজের কণ্ঠ মেলাচ্ছি। অনুভব করতে পারছি যে জানালার ফাঁক দিয়ে দমকা হওয়া এসে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে।

হঠাৎ করে দরজায় ঝোলান উইন্ড-চাইমটা শব্দ করে উঠলো। নাহ, গান গাইবার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। গান গাইবার সময় কোন শব্দ হলে আমার ভীষণ রাগ হয়। আজও তাই হল। আমি ভেবেছিলাম রোদেলা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকবার সময় উইন্ড-চাইমে শব্দ করেছে। তাই ওকে ধমক দেওয়ার জন্য চোখ রাঙ্গিয়ে পেছনে তাকালাম।

দরজায় অঝর দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে, এখানে তাকে দেখব বলে আশা করি নি, তাই খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একদণ্ডে দৃষ্টি নিবন্ধন করলাম মেঝেতে। সে নিজেও খুব বিব্রতবোধ করছিলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তখনি তার ওয়ালেটটার কথা মনে পড়লো। আমি একটানে ড্রয়ার খুলে ওয়ালেটটা বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে কিছুটা ইতস্ততবোধ করল, তারপর হাত বাড়িয়ে ওয়ালেটা নিলো। ঠিক তখনি বিকট শব্দে একটা বাজ পড়লো আর কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকারের মাঝে আমি আর সে...নাহ, সিনেমেটিক কোন কিছু হয় নি আমাদের মাঝে। আই.পি.এস-এর দয়ায় খানিকবাদেই চারিদিক আবার আলোকিত হয়ে গেল।

আমি তার দিকে তাকালাম। সে আমাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। সে অপরাধীর মতো আমার দিকে তাকাল এবং বলল, “আমি আমার আম্মু এবং পরিবারের সকলের পক্ষ থেকে আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কাল সকাল থেকেই আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ ছিল, তাই হয়তো আপনার সাথে কিছুটা মিসবিহেভ করেছে। এর জন্য আমি সত্যি খুব লজ্জিত।

দ্বিতীয়বারের মতো আমি তার কণ্ঠ শুনলাম। জানি না কি আছে তার কণ্ঠে। শুনলেই মনে হয় সে আরও কিছু বলুক। আমি আস্তে করে বললাম, “আরে কি বলছেন এই সব? আপনি এতটাও ফরমাল হবেন না। ঠিক আছে তো, আমি কিছু মনে করি নি।

আমার এই জবাবে তার কোন ভাবান্তর হল কি না, বুঝলাম না। সে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ করে বলল যে তাকে এখন বাসায় ফিরতে হবে। আমি কিছু বললাম না, কিন্তু আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো যে আপনি এখন যেতে পারবেন নাআপনি এখানে বসে আমার সাথে গল্প করবেন। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? তা না হলে এসব কি ভাবছি আবোল তাবোল। তবে আমার মনের আশাটা পূরণ হয়ে গেল। ঝড়-বৃষ্টির কথা বলে রোদেলা তাকে আটকে ফেলল। এর মধ্যে ও আবার চা-ও নিয়ে এসেছে। বাইরের আবহাওয়া খুব একটা ভাল ছিলও না। তাই তাকে বসতেই হল।

অঝর সোফায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে, আর তার পাশে বসে রোদেলা অনবরত বকবক করে যাচ্ছে। আমিও তার সাথে বকবক করতে চাইছি, কিন্তু পারছি না। আমি আমার রুমের ভেতরে চলে গেলাম। জানালার বাইরে তাকিয়ে নানা বিষয় ভাবতে লাগলাম। এরই মধ্যে শুনলাম বাইরের রুম থেকে রোদেলা আমকে ডাকছে-
আপু, বাইরে আসো। অঝর ভাইয়া অনেক সুন্দর গল্প বলছেন।

আমি বাইরের রুমের দরজায় দাঁড়ালাম। অঝর আমার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। মনে হল সে কিছু বলতে চাইছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে বৃষ্টির ছাঁট কমে এলো। অঝর উঠে দাঁড়ালো। রোদেলা অনেক জোর করলো তাকে আরও কিছুক্ষণ থাকার জন্য। কিন্তু সে রাজি হল না। আমি রোদেলাকে বললাম কেন ওনাকে এতো বিরক্ত করছিস? যেতে দে না।সে আমার দিকে তাকালো আর বলল, “আসি তাহলে।

সে চলে যাচ্ছে, আমি পেছন থেকে তার চলে যাওয়া দেখছি। আকাশটার মতো আমারও খুব কাদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু কান্না আসছে না। আশ্চর্য!

এর কিছুদিন পর, রোদেলা খুব জেদ করলো আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার। তাই বিকেলে ওকে নিয়ে ধানমণ্ডি লেকের দিকে গেলাম। এই জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগে। সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে বোটে করে লেকের পানিতে ভেসে বেড়াতে। আজও তাই করতে চাইলাম, কিন্তু রোদেলা বলল যে তার আজকে বোটে চড়তে ইচ্ছা হচ্ছে না। আমার ভীষণ রাগ লাগলো ওর উপরওকে বললাম, “তুই এখানেই থাক। আমি একাই যাচ্ছি।আমি একাই বোটে উঠলাম, ভেসে বেড়াতে লাগলাম লেকের জলে আর গুনগুন করে গান ধরলাম।

দশ মিনিটের মাথায় আমার বোটের পেছনে অন্য একটা বোট এসে ধাক্কা লাগিয়ে দিল। আমি কেপে উঠলাম। চমকে পেছনে তাকাতেই দেখি ঐ বোটে রোদেলা বসে আছে, আর সাথে অঝর। অঝর এখানে এলো কিভাবে!

আমরা আমাদের বোট পারে ভিরালাম। জানতে পারলাম যে এ পথ দিয়েই অঝর অফিসের কাজে কোথাও যাচ্ছিল। রোদেলাকে দেখেই থেমেছে। অনেকটা জোর করেই সে আমাদের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। অঝর মাফ চাইল আমার বোটে ধাক্কা লাগানর জন্য।

কিছু হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়েই দিনটা শেষ হল। একজন মানুষ এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে, সেটা আমার জানা ছিল না। সন্ধ্যা নামার আগেই অঝর আমকে আর রোদেলাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। বিকেলটা কিভাবে কেটে গেল টের-ই পেলাম না। তবে বিকেলটা খুব বিশেষ ছিলো, কারন আজ আমি চমৎকার একজন মানুষের খোঁজ পেলাম















অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(৪র্থ পর্ব)...
                  
ǀǀঅঝরের রংহীন ধুলোǀǀ  

খু
ব দ্রুতই কেটে গেলো তিন মাস। শ্রাবণের সাথে বন্ধুত্বটাও অনেক গভীর হয়েছে। ওকে আমি এখন অনেক জানি, অনেক বুঝি। তবে শ্রাবণের মুখে বারবার শুনতে হয় অঝর তুমি আমাকে একটুও বুঝো না। 
মাঝে মাঝে ভাবি আমি কি সত্যিই শ্রাবণকে বুঝি না? না বুঝলে কেনই বা এই সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইক নিয়ে বের হলাম? রোদেলার কাছ থেকে শোনা, কদম ফুল নাকি শ্রাবণের অনেক পছন্দের
তাই ওকে নিয়ে আজ কদমফুল আনতে যাবো। 

ছুটির দিনের কাঁচা ঘুমটা হারাম হয়ে গেলো, এই জন্য আমার আফসোস নেই। কিন্তু বাতাসে রাস্তার বালি গুলো সব চোখে এসে ঢুকছে। মেজাজটা সত্যি ভীষণ রকম বিগড়ে যাচ্ছে।
 

আজকের আকাশটা অনেকটা মেঘলা। ঝরো হাওয়া রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আন্টি আমার আসা-যাওয়াটা মোটেও পছন্দ করেন না, তাই বাধ্য হয়ে শ্রাবণদের বাড়ির সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আধ ঘন্টা যাবত। নবাবযাদীর এখনো আসার নাম নেয়। রাগের মাত্রাটা চরমে উঠে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই শ্রাবণকে দেখতে পেলাম। নীল রঙের জামা পড়েছে, হাত ভর্তি নীল চুরি, কপালে বড় একটা নীল টিপ, আর চোখে গাড় করে কাজল দেওয়া। ওকে দেখা মাত্রই ওর উপর সমস্ত রাগ দমে গেল। শ্রাবণ মিষ্টি করে বলল- আরে আজ এত আগে চলে এলে কি করে?”
 
প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। ওর চোখের সাগরে ডুব দিয়ে গা ভিজিয়ে আনতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওকে পিছনে বসিয়ে ঝরো হাওয়ার মাঝেই বাইক নিয়ে ছুটলাম। বাইকের সাইডগ্লাস দিয়ে বারবার ওর উড়ে যাওয়া চুল গুলো দেখতে দেখতে ছুটতে লাগলাম।
 

কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজন। আমাদের বাংলো বাড়ির কেয়ার টেকারের ছেলে মতিন মিঞ্ছা গাছ বেয়ে উপরে উঠছে। হাতে চারটা কদম নিয়ে নিচে নেমে আসলো মতিন, আমার হাতে ফুলগুলো ধরিয়ে দিয়েই দৌড়ে পালালো। মনে হল, এতক্ষন পর কোণ বাঘ বা ভাল্লুক দেখেছে। ফুলগুলো দুই হাতে নিয়ে শ্রাবণের হাতে দিলাম। ফুলগুলো হাতে নিয়েই শ্রাবণ মনের আনন্দে গুনগুন করতে লাগলো-
 

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
করেছ দান
 
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান
 

মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে
 
...রেখেছে ঢেকে তারে
 
এই যে আমার সুরের ক্ষেতের ও প্রথম সোনার ধান
 

আজ এনে দিলে
 
হয়তো দেবে না কাল
 
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল
এ গান আমার
 
শ্রাবনে শ্রাবনে তব বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে
 
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান।
 

মুগ্ধ হয়ে গান শুনছিলাম। শ্রাবণকে বাসায় দিয়ে ভিসা অফিসে গেলাম। হ্যাঁ, জবের কাগজপত্র চলে এসেছে। অনেকটা খুশি মনেই বাসায় ফিরে এলাম। ভিসার কাগজপত্র ঠিক-ঠাক করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল। অফিস আর দৌড়া-দৌড়ীর কারনে শ্রাবণের সাথে দেখা করা হয়ে উঠে নি। এদিকে আমার বাইরে যাবার ডেটও ঠিক হয়ে গেছে। আগামী মাসের ৩ তারিখ। অনেকটা খুশি মনেই শ্রাবণকে কথাগুলো জানাতে গেলাম। সে দিন বাসায় আন্টি থাকায়, ঘরের ভেতর ঢুকা হয় নি। রোদেলা আমার হাতে একটা কার্ড টাইপের কিছু ধরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। হ্যাঁ, শ্রাবণের বিয়ের কার্ড। আমি কি খুশি হয়েছি না কষ্ট পাচ্ছি বুঝে উঠতে পারলাম না।
 

আজ রাতের আকাশটা অনেক বেশি সুন্দর। একটা পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। আমার মাঝে এই সৌন্দর্য কোন রকম অনুভূতি সৃষ্টি করছে না। হঠাৎই হিমেলকে ফোন দিয়ে পেয়ে গেলাম লাইনে। হিমেলের মুখ থেকে কিছু নির্মম সত্য শুনলাম। হিমেল বলেছিল, ও নাকি ওর গীটারটা ওর ভালবাসার মানুষটাকে জন্মদিনের উপহার কিনে দেওয়ার জন্য বিক্রি করেছে। কিন্তু আসল সত্যটা হল-চন্দ্রা নামের সেই মেয়েটি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। হিমেল ওর সর্বস্ব দিয়ে, এমনকি বই পত্র, ঘড়ি, মোবাইল সব বিক্রি করেও মেয়েটিকে বাঁচাতে পারে নি। আজকের চাঁদটা অন্য দিনের মত আমাকে আর মুগ্ধ করছে না। আমি যেন স্থির হয়ে পড়ে আছি ছাঁদের উপর।
 

কিছুটা কাকতালীয় হলেও ঘটনাটা এই রকম হয়েছে, শ্রাবণের বিয়ের তারিখ আর আমার বাইরে যাবার তারিখ মিলে গেলো। মানে তিন তারিখ।
 

মেহমানদেড় সারিতে বসে আছি। হঠাৎ রোদেলা হাত ধরে শ্রাবণের ঘরে নিয়ে গেলো। শ্রাবণ আজ অনেক সুন্দর করে সেজেছে। ওকে দেখতে সত্যিই কোন রাজকন্যার চেয়ে কম লাগছে না। লাল শাড়ি আর লাল টিপে ওকে অনেক মানিয়েছে। আম্মু ওকে এইরূপে দেখলে নিশ্চয় পছন্দ না করে থাকতে পারতেন না।
 
শ্রাবণ রোদেলাকে ড্রয়ার থেকে একটা কাজল বের করতে বলল। কিন্তু রোদেলা যে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে এবং আমি ঘরে ঢুকেছি। টেরও পায়নি শ্রাবণ। আর পাবেই বা কি করে, চারপাশে এত মেয়ে ভিড় করে আছে যে।
 
আমি ড্রয়ারের দিকে এগুচ্ছি। ড্রয়ার খুলতেই চিঠির মত কতগুলো কাগজ আমার চোখে পড়ল। একটা কাগজের গায়ে লিখা প্রিয় অঝর বাবু। আমি এই কাগজটি নিয়ে পড়তে শুরু করলাম-
 

প্রিয় অঝর বাবু,
ভাল আছ তো? এটা কত নাম্বার চিঠি, জানো? এটা হচ্ছে তোমার কাছে লেখা আমার ৮৮ নাম্বার চিঠি। তুমি যেদিন আমাদের বাসায় তোমার ওয়ালেটটা নিতে এসেছিলে, সেদিন থেকে প্রতিরাতে আমি তোমার জন্য একটা করে চিঠি লিখি, আর লেখা শেষে খুব যত্ন করে সেগুলো ড্রয়ারের ভেতরে রেখে দেই
 
আজ তুমি কি একটা কাণ্ড করলে! আমার জন্য কদম ফুল আনতে এতো কাহিনী! কিন্তু কদম ফুল যে আমার খুব প্রিয় সেটা কিভাবে জানলে তুমি? নিশ্চয়ই রোদেলা বলেছে, এই মেয়েটা না!! তবে আজকের দিনটির কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। তুমি যখন কদমফুল গুলো আমার হাতে তুলে দিলে, তখন আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। আমাকে কেউ কখন এভাবে কদমফুল দেয় নি।
 
আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ভালবাসবে? আমার জন্য সবসময় ঠিক এভাবেই কদম ফুল আনবে? আমার কদম ফুল সত্যি খুব ভাল লাগে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ভাল লাগে তোমাকে। আমি তোমাকে ভালবাসি। অনেক বেশি ভালবাসি। আজ পর্যন্ত সাহস করে এই কথাটা তোমাকে বলতে পারিনি, হয়তো কোনদিন পারবও না। আমি কোনভাবেই তোমাকে হারাতে চাই না। চলুক যেভাবে চলছে। আমার মনের এই ছোট্ট শব্দ তিনটি মনেই রয়ে যাক...
 
ইতি,
 
তোমার শ্রাবণ











অঝর-শ্রাবণ.jpg "অঝর শ্রাবণ"(৪র্থ পর্ব)...
                 
ǀǀঅতঃপর শ্রাবণ সমাচারǀǀ 
ঝরের সাথে পরিচয়ের পর থেকে সময় যেন উড়ে উড়ে যেতে লাগলো। দেখতে দেখতে তিনমাস হয়ে গেল। এতদিনে ওকে বেশ ভালোমতই বুঝতে শিখেছি। ছেলেটা খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে পারে, মনটাও ভীষণ ভাল। আর মাঝে মাঝে একটু পাগলামি করে। গত রাতে আমাকে বলল যে সকালে যেন রেডি থাকি, আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলছে না।

সাত সকালে উঠেই রেডি হলাম। নীল সালোয়ার-কামিজ সাথে মিলিয়ে হাতে পরলাম অনেকগুলো নীল কাঁচের চুড়ি আর কপালে বড় একটা নীল টিপ। হাত ভরে চুড়ি পরলে নাকি আমাকে খুব সুন্দর লাগে। এই কথা আমি অঝরের কাছেই প্রথম শুনেছি। কচ্ছপের গতিতে রেডি হচ্ছিলাম, কারন জানি যে এত সহজে তার ঘুম ভাঙবে না। বড় জোর আরও ২ ঘণ্টা তো লাগবেই এখানে আসতে।

আমি রেডি হয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে লাগাতার বাইকের হর্ন শুনলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অঝর নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে বুঝলাম না। নিজের কাঁচা ঘুম হারাম করে উনি এতো সকালে হাজির হলেন কিভাবে! আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগটা কাঁধে তুলে পা টিপেটিপে বের হলাম। কারন আম্মু যদি জানতে পারে, তাহলে আমার আর রক্ষা নেই। নিচে নেমেই আগে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “আরে আজ এত আগে চলে এলে কি করে?” সে কোন উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার দিকে বললে ভুল হবে, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ করে বলল বাইকে বসতে।

আমাকে পেছনে বসিয়ে সে ঝড়ের বেগে বাইক ছুটালো। আমার একটু ভয় ভয় লাগছিল। কিন্তু অঝর সাথে আছে ভেবে ভয়গুলোও বাতাসের সাথে উড়ে গেল। প্রচণ্ড বাতাসে আমার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। এই অশান্ত বাতাস উপেক্ষা করেই আমরা ছুটে চললাম।

অঝর আমাকে ওদের বাংলো বাড়িতে নিয়ে এসেছে। জায়গাটা খুব সুন্দর, চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। আমরা এখন একটা কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। বাংলোর কেয়ার টেকারের পিচ্চি ছেলেটা গাছে উঠে কদম ফুল ছিঁড়ছে। আমি বুঝতে পারলাম যে শুধুমাত্র এই কদম ফুল নিতেই এতো দূর আসা। মানুষ এত পাগল হয় কিভাবে! পিচ্চিটা গাছ থেকে নেমেই অঝরের হাতে চারটা কদমফুল দিয়ে দৌড়ে পালালো। মনে হল সে অঝরকে অনেক ভয় পায়। ফুল চারটা সে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। জীবনে কোনদিন কদমফুল দেখে এত বেশি আনন্দ হয় নি। ফুলগুলো হাতে নিয়ে গুনগুণ করতে লাগলাম-

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
করেছ দান
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান

মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে
...
রেখেছে ঢেকে তারে
এই যে আমার সুরের ক্ষেতের ও প্রথম সোনার ধান

আজ এনে দিলে
হয়তো দেবে না কাল
রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল
এ গান আমার
শ্রাবনে শ্রাবনে তব বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে
ফিরিয়া ফিরিয়া আসিবে তরণী বহি তব সম্মান।

বিকালের দিকে অঝর আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। ওকে বিদায় জানিয়ে কদম ফুলগুলো হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকলাম, পড়লাম আম্মুর সামনে। আম্মু আমার দিকে একবার, কদমফুলগুলোর দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল, “ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আয়। কিছু কথা আছে।
কোন এক অজানা কারনে আমার খুব ভয় হচ্ছিল। কারন এত বেশি সুখ পাওয়ার মতো ভাগ্য আমার নেই। নিশ্চয়ই অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আম্মু বলল যে কাল আবার আমাকে কেউ দেখতে আসছে, ১২ তম পাত্রপক্ষ।

আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, আগামী মাসের ৩ তারিখ। ছেলের নাকি আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আমার মতো গুণী মেয়েই ওরা খুজচ্ছিল, গায়ের রঙ তাদের কাছে কোন বড় ব্যাপার না। আব্বু-আম্মুরও ছেলেকে বেশ পছন্দ। এর মাঝে কি আমার আর কিছু বলার থাকে? আমার তো খুশি হওয়ার কথা। অবশেষে কোন ছেলে আমাকে পছন্দ করলো। কিন্তু কেন জানি আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল, খুব বেশি খারাপ হয়ে গেল।

অঝরের সাথে বেশকিছুদিন ধরে ঠিকমতো যোগাযোগ নেই। কিছু একটা নিয়ে ও ভীষণ ব্যস্ত। জিজ্ঞেস করলে বলে পরে বলবে, সারপ্রাইজ। এদিকের কোন খবরই সে জানে না। কিভাবে জানবে, সে তো তার নিজের কাজ নিয়েই অনেক ব্যস্ত। অবশেষে একদিন বিকালে অঝরের ফোন পেলাম। বলল যে খুব শীঘ্রই আমার সাথে দেখা করবে সে। ওকে সব কথা বলতে গিয়েও বললাম না। ভাবলাম সামনাসামনি দেখ হলেই সব বলবো।

বিয়ের সব আয়োজন শুরু হয়েছে, কার্ডও ছাপানো হয়ে গেল। রোদেলা এসে সেই কার্ডের প্রতিটা শব্দ আমার সামনে চিৎকার করে পড়তে লাগলো। আমি কিছুই অনুভব করতে পারছি না। নিজেকে পাথরের একটা মূর্তি মনে হচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ পেলাম। রোদেলা ছুটে গেল দরজা খুলতে। আমি আমার তানপুরা হাতে বসে রইলাম। কিছুতেই সুর মিলছে না।
রোদেলা রুমে ঢুকেই বলল যে অঝর এসেছিলো। আমার বুকটা ধক্‌ করে উঠলো ওর নামটা শুনে। রোদেলা নাকি ওকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়েছে। শুনলাম কার্ডটা হাতে নিয়ে সে বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর বলল,
তোমার আপুকে বল, আমি বাইরে চলে যাচ্ছি। ৩ তারিখ আমার ফ্লাইট।বলেই চলে গেল।

এবার আমার ভীষণ কষ্ট হল, নিজের ভেতরেই দুমড়ে-মুচড়ে যেতে লাগলাম। তানপুরাটা হাতে নিলাম, আর এই প্রথম আমার হাতে আমার প্রিয় তানপুরার তার ছিঁড়লো। সব সুর কেটে গেল, সব সুর এলোমেলো হয়ে গেল।
আমাদের বাসাটা আজ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। আমি আমার রুমে বসে আছি। আমার পরনে লাল জামদানী। রোদেলা বারবার বলছে যে আমাকে নাকি আজ খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু আমি একবারও আয়নার দিকে তাকাই নি। কারন আয়নায় নিজের চেহারা দেখলে নিজের জন্য করুণা হয়। হঠাৎ করেই চোখটা ভিজে এলো। আমাকে ঘিরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে কাঁদতে ইচ্ছা করেছে না। ধুর, কাজলটা নিশ্চয়ই লেপটে গেছে।
এই রোদেলা, ঐ ড্রয়ার থেকে আমার কাজলটা দে তো।

মেয়েগুলো খুব বেশি হাসাহাসি করছে। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। আর এই রোদেলাটা একটা কাজল বের করতে এতো সময় কেন লাগাচ্ছে! আমি পেছন ফিরে ওকে বকা দেওয়ার জন্য ঘাড় ঘুরালাম। রোদেলা রুমে ছিল না। কিন্তু আমার ড্রয়ারের কাছে অঝর দাঁড়িয়ে ছিল। ঐ ড্রয়ারে রাখা ছিল অঝরকে লেখা ৯৮টা চিঠি। সেই চিঠির একটা আমি অঝরের হাতে দেখতে পেলাম। এমন হওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল?

চিঠিটা পড়ে অঝর আমার দিকে তাকাল। আমি তার চোখে বিষণ্ণতার ছোঁয়া দেখলাম। মনে হল তার চোখের কোণে এক ফোঁটা জল চিকচিক করছে। আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারিনি ঐ চোখের দিকে। চিঠিটা হাতে করেই দ্রুত পায়ে অঝর বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সাথে সাথেই রোদেলা রুমে ঢুকল।
আপু, অঝর ভাইয়া চলে গেল কেন? আমি তো ওনাকে নিয়ে এলাম তোমাকে দেখানোর জন্য। কি হয়েছে?”
জানি না।

বাইরে থেকে হৈচৈ শোনা গেল। মনে হয় বরযাত্রী চলে এসেছেন। হৈচৈ শুনে সবাই বাইরে চলে গেল। আমি উঠে ড্রয়ারটার দিকে এগিয়ে গেলাম। চিঠিগুলো হাতে তুলে নিলাম। আমার চোখের কাজল ধুইয়ে দিয়ে চোখের জল টপটপ করে চিঠিগুলোর উপর পড়ছিল।
চিঠিগুলো আর একটা ম্যাচবক্স নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত শিখায় সঁপে দিলাম আমার লুকিয়ে রাখা ভালবাসার চিহ্নগুলো, বিসর্জন দিলাম নিজের নিজের সত্ত্বাকে।

হঠাৎ করেই দরজায় আওয়াজ করলো কেউ। রোদেলার কণ্ঠ শুনলাম, “আপু, বাইরে আসো তাড়াতাড়ি। বুঝতে পারলাম আমাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ডাকাডাকি করছে ও। আয়নার দিকে তাকালাম। ছড়িয়ে যাওয়া কাজলটা টিস্যু দিয়ে মুছে ঠিক করে নিলাম। দরজা খুলতেই দেখলাম রোদেলা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে আরেকটি মুখ।
অঝর! তুমি! তুমি না চলে গিয়েছিলে!আমি কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মতই জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

অঝর চুপ করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই বলল, “শ্রাবণ, আমার বউ হবা?”
আমি একরকম মূর্তি হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। আজ আমার বিয়ে, আর এখন অঝর আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করছে! অবশ্য আমিও তো ওকে আগে কিছু বলি নি।

আপু, এতো কি ভাবছ! হ্যাঁ বল, দুলাভাই হিসেবে অঝর ভাইয়াকে আমার সেই প্রথম থেকেই অনেক পছন্দ। আর শোন, তোমাদের মেয়ের নাম কিন্তু অবশ্যই ধারা রাখবা... অঝর-শ্রাবণ-ধারা।

রোদেলা, তুই একটু থামবি!অঝরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে রোদেলার কথায় মুচকি হাসছে!
খুব হাসি পাচ্ছে, না?? আগে বলতে পারো নি?? এখন কি হবে?? আর তোমার আম্মু......

থামো তো। আম্মুকে আমি ঠিকই ম্যানেজ করবো। আগে বল, এখান থেকে কিভাবে বের হব। আমার মাথায় কিছুই আসছিলো না।

ভাইয়া, পেছনের বারান্দা দিয়ে বের হয়ে যান তো, সবাই সামনের দিকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।রোদেলা বলল।

অঝর আমার দিকে তাকাল এবং তার হাতটা বাড়িয়ে দিল আমার পাণে। আর আমি সেই হাত ধরলাম পরম শান্তিতে আর অগাধ বিশ্বাসে......
___________________________________সমাপ্তি ________________________________

শেষ কথাঃ কিছুটা তড়িঘড়ি করেই লিখে ফেললাম “অঝর-শ্রাবণ” গল্পটি। তবে আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের সর্বোচ্চ দিতে। গল্পটিতে আপনাদের অভূতপূর্ব সাড়া দেখে আমরা সত্যি আবেগাপ্লুত। আপনাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আশা করি আপনারা আমাদের পথচলার সাথী হয়ে থাকবেন সবসময়।

গল্পতে ‘অঝর’ চরিত্রটি লিখেছেন- ক্ষণিকের আগুন্তুক এবং ‘শ্রাবণ’ চরিত্রটি লিখেছেন-একজন লেখিকা। গল্পটি সম্পর্কে যেকোনো মতামত দিতে যোগাযোগ করতে পারেন এই ঠিকানায়-
abegmoyvalobasha@gmail.com                  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন