শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

জনৈক হিমুর এলোমেলো একটি দিন

 কিছু কথাঃ “হিমু” নিয়ে সবার ফ্যান্টাসিটা একটু বেশিই। আর এই ফ্যান্টাসি সৃষ্টির মূলে রয়েছেন সাহিত্যের জাদুকর “হুমায়ূন আহমেদ” স্যার। তার অনবদ্য সৃষ্টি এই “হিমু” চরিত্রটি খুব দ্রুতই সবার মন জয় করে নিয়েছে। স্যারের অকালে চলে যাওয়া আমাদের যতটা দুঃখ দিয়েছে, ঠিক ততটাই দুঃখ দিয়েছে তার সৃষ্ট “হিমু” চরিত্রটির অকালে ঝড়ে যাওয়া তে। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে তাকে উৎসর্গ করে আমার এই ছোট একটি লিখা।

অফিস থেকে বাসায় ফিরবার পথে বিশ্বাসঘাতক গাড়িটা হিমাদ্রির সাথে আবারো বিশ্বাসঘাতকতা করলো। একে তো কুকুর বিড়ালের মত বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, আরেকদিকে গাড়িটা ঝিম মেরে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। কোনমতে গাড়িটা লক করে, দ্বিগুণ ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি ধরে, কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরল সে। কলিংবেল টিপতেই বুয়া দরজা খুলে দিল। হিমাদ্রির ধারনা ছিল হয়তো দরজাটা রূপা-ই খুলবে। রূপা হলো হিমাদ্রির সদ্য বিবাহিত বউ, যদিও লাভ ম্যারেজ তবুও জামাই জামাই ভাবটা একটু বেশিই খাটাতে চায় হিমাদ্রি।  ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো রূপা সোফায় বসে বই পড়ছে আর জোরে জোরে হাসছে, বইয়ের নাম... “হিমু রিমান্ডে”, বইয়ের নাম দেখে তার মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে সারাটা দিন হিমু নিয়ে বসে থাকে, একই বই বারবার করে পড়ে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার জামাই যে অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে, সেদিকে তার কোন নজরই নেই! সে আছে তার হিমু নিয়ে! নাম রূপা হলেই কি হিমুর জন্য এতো বেশি পাগল হতে হবে? পৃথিবীর সব রূপা-ই কি হিমুর জন্য পাগল হয়!

মাঝে মাঝে সুযোগ বোঝেই কিছু কমন কথা শোনায় রূপা, বিশেষ করে শপিঙে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে। তার মধ্যে কিছু  হল- খবরদার কোন মেয়ের দিকে তাকাবা না, কারন হিমুরা কোন মেয়ের দিকে তাকায় না। হিমুর মত হতে চেষ্টা করো, জানি কখনো পারবা না, তারপরও বলি। আর অফিসে যাওয়ার আগে প্রতিটাদিন ওর কাছ থেকে একই কথা শুনতে শুনতে হিমাদ্রি অতিষ্ঠ হয়ে গেছে- খবরদার ভুলবশতও কোন কলিগ বা অন্য কোন মেয়ের হাত স্পর্শও করবা না। হিমুরা এই কাজ কখনই করে না। একবার শপিঙে গিয়ে ভুলক্রমে হঠাৎ এক মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগাতেই যে কি কাহিনী ঘটে গিয়েছিল ওদের মাঝে!!! তা না হয় অব্যক্তই রয়ে যাক।

“রূপা, বৃষ্টিতে ভিজে মাথাটা একটু ব্যাথা করছে। এক কাপ আদা চা বানিয়ে দাও তো।” হিমাদ্রি রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলে।

“বুয়া, তোমার ভাইজানের জন্য এক কাপ আদা চা নিয়ে এসো।” বই থেকে চোখ না সরিয়েই কথাটা বলল রূপা।

“রূপা, আমি তোমাকে বলেছি চা বানিয়ে আনতে।”

“উফ, দেখছই তো আমি হিমু পড়ছি। ডিস্টার্ব করো না তো!”

“এসবের মানে কি? হিমু হিমু হিমু...সারাটা দিন হিমু নিয়ে পরে থাকো। আর কোনদিকে তোমার কোন খেয়াল নেই। রোজ রোজ এসব কিন্তু ভাল্লাগে না।”

এবার রূপা বই থেকে চোখ তুলে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল,  “বিয়ের আগে আমি তোমাকে বলি নাই যে আমি হিমুর কত বড় ভক্ত? বলি নাই যে আমি রাত-দিন হিমু পড়ি? বলি নাই?”

“হুম, বলেছ।”

“এসব শুনে তখন কি বলেছিলা মনে আছে?? তাহলে আমি তোমার হিমু হব, তুমি হবা আমার রূপা। আমি হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াবো, আর তুমি আমার রূপা হয়ে বারান্দায় বসে অপেক্ষা করবা।”

হিমাদ্রি একদম চুপ হয়ে শুনছে সব। কারন সে কথাগুলো সত্যি এসব বলেছিল।


“কি চুপ মেরে গেলা কেন? মনে পড়ে এইসব কথা? বড় ভাইয়ার বন্ধু ছিলা বলে প্রায় তো বাসায় আসতা। আমি বই পড়তাম আর তুমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখতা। ভাইয়ার মুখে শুনলাম তোমার নাম নাকি হিমু! হিমাদ্রিকে সবাই নাকি সংক্ষেপে হিমু বলে ডাকে! তখন থেকেই তোমার প্রতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ি, ভেবো না তোমার কারনে, কারনটা ছিল তোমার নাম। আর কত কিছুই না ভেবেছিলাম তোমার সম্পর্কে, কত আকাশ-কুসুম চিন্তাও করেছিলাম! ভেবেছিলাম তোমার মধ্যে হিমুর সব গুণাবলী বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু হায়!

যাই হোক, তখনতো পটানোর জন্য কত কথাই বলেছিলা,  কিন্তু বিয়ের পর তো আর কিছু মনে রাখার দরকার হয় না, তাই না? আসলে সবাই ঠিকই বলে, বিয়ের পর সবকিছু বদলে যায়, সব।” রূপা অফসোস মাখা কন্ঠ নিয়ে কথাগুলো বলেই হিমাদ্রির সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে যায় পাশের ঘরে। হিমাদ্রি চুপ হয়ে বসে থাকে, তার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। বিয়ের আগে রূপা সত্যিই বলেছিল যে হিমু নাকি তার প্রথম ভালবাসা।


অন্ধকার কালো রাত, হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে কালো কালো মেঘের মাঝ থেকে চাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। অপূর্ব এক দৃশ্য। কিন্তু আজ এই দৃশ্য হিমাদ্রিকে নাড়া দিচ্ছে না, ছাদের চিলেকোঠায় বসে আছে। বিষণ্ণতা যেন তাকে গ্রাস করে গেছে কিছু সময়ের জন্য, কিছুটা আনমনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে আজ-কালকের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি হয়ে যাবে। রূপা রাগ করে না খাওয়ায়, সেও কিচ্ছু খায় নি। রাত অনেক হয়েছে, কিছুটা ক্ষুধাও লেগেছে হিমাদ্রির।


মাঝরাতে কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে ঘরে ঢুকল হিমাদ্রি, না সব ঠিক আছে। সোফার উপরে বইটা তখনও তেমনি পরে আছে। পাশের রুমেই রূপা ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সে ঘুমের মধ্যেও রেগে আছে। রূপার রেগে থাকা মুখের দিকে চেয়ে থেকেও যেন হিমাদ্রির শান্তি শান্তি লাগছে। কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু এমনটা করা সম্ভব নয়, রূপার ঘুম ভাঙলে ওর খবর আছে!!! ফ্রিজ থেকে কেক বের করে খেয়েই, বইটা হাতে নিলো হিমাদ্রি, পুরো বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলো। তার অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির জন্য তার নিকট শুধু একটা রাস্তায় খোলা আছে, আর সে রাস্তা ধরে হাঁটার জন্য  হিমাদ্রি ঠিক করলো, সে হিমু হবে। হিমু হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে, কোন মেয়ের দিকে তাকাবে না, কোন মেয়ের হাত ধরবে না। আর রূপা হবে, হিমুর রূপা।


সকাল হয়ে এসেছে। একটি চিরকুট বইটির মাঝে গেঁথে দিয়ে উদাস মনে বের হয়ে এলো বাসা থেকে। পায়ে কোন জুতো নেই, মানিব্যাগও সাথে করে আনা হয় নি, সাথে যা আছে তার একটি ছোটখাটো বিবরণ দাঁড় করনো যায়- শার্ট, প্যান্ট আর পকেটে ২৫০ টাকা।

২৫০ টাকাও আনা হতো না, আনার পিছনে কারন হচ্ছে, বাসায় কোন হলুদ রঙের পাঞ্জাবী নেই। তাই বঙ্গ থেকে পাঞ্জাবী কিনার জন্যই এই টাকা নিয়ে বের হওয়া। বাসা থেকে বের হতেই একটা লংকা-কাণ্ড ঘটে গেল। দুষ্টু কাক, হিমাদ্রির উপর পয়ঃনিষ্কাশন করেছে। কি পরিমান মেজাজ গরম হয়েছিল  হিমাদ্রির, তা ওকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। তবে কিছুক্ষণ পর, এটাকে সে ভাল দিক হিসেবেই গণ্য করলো। আর নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই হোক বা অন্য কোন কারনেই হোক মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো, হিমু হওয়ার প্রথম ধাপ হয়তো এটা। তাই মেজাজ গরম করার কিছু নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা একটা কাগজ তুলে পরিষ্কার করে নিলো জায়গাটা। তারপর আবার আপন মনে হাটতে লাগলো।


আজ পহেলা বৈশাখ। চারদিকে রমণীর অভাব নেই, আর তাদের সাথে আছে সেই চিরচেনা হ্যাবলা-গাবলার দল। রমণীর পেছন পেছন ছুটা ছাড়া এই হ্যাবলা-গাবলা দলের মানুষের আর কোন কাজ নেই। হাইরে, কাপুরুষের দল, নিজেকে কিভাবে সোপর্দ করেছে একটা মেয়ের কাছে!!! দেখলেই ওদের জন্য খুব মায়া হয় হিমাদ্রির।  উদাস ভাবটা আরো কিছুটা বেড়ে যায়। আনমনে গত বৈশাখের কথা আউড়াতে থাকে সে-


গত বৈশাখ!!! হিমাদ্রি, রূপা আর রূপার ছোট ভাই হৃদ্য।  আশুলিয়াই যাচ্ছে, খুব স্পিডে গাড়ি চালায় হিমাদ্রি, এই নিয়ে রূপার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। হৃদ্য তো বেশ এক্সসাইটেড, সবে মাত্র ভার্সিটিতে পা দিয়েছে। চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন। তাই দোলাভাইকে অনেক কষ্টে জোড় করে একটা ইংলিশ গান “আই কেন বি ইউর হিরো” ছাড়তে বাধ্য করলো।


হিমাদ্রি এই যুগের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার রবীন্দ্রপ্রীতি অনেক বেশি। সে এই ধরনের ইংলিশ গান শুনে অভ্যস্ত না। তারপরও কেন যেন গানটা খারাপ লাগছে না। আজকের আকাশটা কিছুটা মেঘলা, হয়তো এই জন্যই সে বার বার রূপাকে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বলছে, কিন্তু ছোট ভাইয়ার সামনে সে গান গাইবে না, ইশারায় বলছে। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে গাড়ির স্পিড আরো কিছুটা বাড়িয়ে দিলো সে।


বিকেলের রোঁদ যখন গায়ে এসে পড়ছে, মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ রোদের, ঠিক তখনই আশুলিয়ার খেয়া ঘাঁটে এসে পৌঁছালো তারা। নৌকায় উঠেই হৃদ্য চেঁচিয়ে উঠলো, জীবনে মনে হয় প্রথমবারের মত নৌকায় উঠেছে। হিমাদ্রির ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে ফেলে দিতে নৌকা হতে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে রূপা পাশেই আছে। সে ঠিক বলবে,

“আমার ভাইকে পানিতে ফেলেছো, এখন তুমি গিয়ে ওকে উঠিয়ে নিয়ে আসো। তুমি জানো না আমার ভাইটা আমার কত আদরের”

তাই মাথা থেকে ওকে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছাটা ঝেরে ফেলে দিয়ে রূপার দিকে মনোযোগ দিলো সে। মেয়েটাকে শাড়িতে আরো অনেক বেশি ভাল লাগে। নদীর জল থেকে কিছুটা হাতে নিয়ে রূপার দিকে ছুরে মারলো সে। পাশ থেকে হৃদ্য চেঁচিয়ে উঠলো-

“আপনার বউ এর গায়ে পানি ছিটাবেন, ভাল কথা। কিন্তু আমি তো আপনার বউ না, এমনকি আপনার শ্যালিকাও না, আমার গায়ে কেন পানি ছিটাচ্ছেন?”

একটু পরেই ধপাস করে একটা শব্দ হলো, নৌকা দুলছে। আর রূপার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে- সে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি বলছে।


ধানমন্ডি লেক। কখন যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে, খেয়ালও নেই। লেকের পানি বেশ ভালই। কপোত-কপোতীরা বেশ সাঁজ-গোঁজ করেই এসেছে দেখা যাচ্ছে। ওদিকটায় এক কপোতী তার কপোতার উপর চিল্লাচ্ছে। মনে হয় তার কপোতার পরিহিত পাঞ্জাবী পছন্দ হয় নি। কেমন যেন উদাস হয়ে এসেছে হিমাদ্রি। সে নিজেকে কনট্রোল করার চেষ্টা করছে। হিমুদের এত সহজে উদাস হলে চলবে না। তাকে আরো অনেক বেশি সংযমী হতে হবে নিজের ব্যাপার গুলো নিয়ে। আর সেই প্রক্ষিতেই ৮নং ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিলো সে, তার উদাস ভাবটা এতে হয়তো কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে হিতে-বিপরীত হতে পারে, সেটা তার ধারণার বাইরে ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিকে বেশ হৈচৈ বেঁধে গেলো। কপোত-কপোতীরা সবাই এসে ভিড় জমালো। অনেকে অনেক কথা বলাবলিও করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো পানিতে পুরোপুরি ভিজে যাওয়া কেউ একজনকে লেকের ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হলো। উদাস মনে সে আবার হাঁটা শুরু করলো। পরের গন্তব্য বঙ্গ বাজার।


বঙ্গ বাজার। শরীর কাট পোড়া রোঁদে শুঁকিয়ে গেছে ততক্ষণে। কম হাঁটতে হয় নি তাকে, পুরো ধানমন্ডি এরিয়া পাড় হয়ে, সাহাবাগ হয়ে, প্রেস ক্লাব, পল্টন, তারপর আরো বেশ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শেষে এই বঙ্গ। ক্ষুধাও লেগেছে প্রচণ্ড। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা শুধু একদিকেই আটকানো- ২৫০ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবী কিনতে হবে। কিন্তু এত কম টাকায় কিভাবে পাঞ্জাবী কিনবে, এটা ভেবে টেনশন হচ্ছে, একটা বিড়িও ফোঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু টাকার সল্পতার জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ভেতরে ঢুকল হিমাদ্রি। ঢুকতেই ছেলেদের কাপড়ের সমাহার চোখে পড়লো। প্যান্ট, শার্ট, ট্রাউজারের তো দেখা মেলছে সচরাচর, কিন্তু পাঞ্জাবীর দোকান খোঁজে পাছে না। কিছুক্ষণ পরই একটা হলুদ পাঞ্জাবীর দিকে চোখ পড়লো। হ্যাঁ, পেয়েছে সে। যদিও কিছুটা ইতস্তত হয়েই দোকানদারকে এর প্রাইস কত জিগ্যেস করলো। দোকানদার হাসি মুখে উত্তর দিলো একদাম ২০০,  এরপরের ঘটনাটা কিছুটা এই রকম- হিমাদ্রির মুখে রাজ্যের প্রশান্তির হাসি ফোটে উঠলো যেন মনে হচ্ছে মাত্র জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। পকেট থেকে ২০০ টাকা বের করে দোকানদারকে দিলো, এরপর সেই জায়গাতেই সেই পাঞ্জাবী পড়ে, তার পরনে থাকা কেটস আইয়ের শার্টটা হাসি মুখে দোকানদারকে গিফট করে রওনা হলো পরের গন্তব্যে।


রূপা,
বিয়ের আগে তোমাকে বলা কথাগুলো ভুলি নি আমি। ঠিক মনে আছে সব। আমি তোমার হিমু হবো, তোমার স্বপ্নের হিমু হবো। আর তুমি রূপার মতো আমার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। মন ভুলানো কথা বলছি না তোমাকে। যা বলছি তা আমি করবই, আমি তোমার ইচ্ছা পূরণ করবই। সেদিন নিশ্চয়ই তুমি খুব খুশি হবে। তোমার ঠোঁটে ঐ হাসির ঝিলিক দেখার জন্যই একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমার নামকে নয়। হিমুরা তো পরিব্রাজক হয়, তাই না? আমিও তাই বেরিয়ে পড়লাম। আমার জন্য ভেবো না। আজ নীল একটা শাড়ি পড়ো রূপা, কপালে একটা নীল টিপ দিও। কেন জানি মনে হচ্ছে নীলের মাঝে রূপা আরও বেশি উদ্ভাসিত হবে। পারলে চোখে গাঢ় করে কাজল লাগিয়ো।
ইতি-
হিমু


চিরকুটে লিখা কথাগুলো আউড়াতে আউড়াতে রমনা পার্কে প্রবেশ করে হিমাদ্রি। তার এখন নতুন পরিচয় সে হিমু, অন্তত রূপার জন্য হলেও তাকে হিমু হতে হবে। উদাস হয়ে বেশ কিছুক্ষণ পার্কের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে পানির ধারের একটা বেঞ্চে বসে পড়লো। চারিদিকে রমণী আর বমনাদের আনাগোনায় ভরে গেছে পার্ক। উদাস ভাবটা কাটানোর জন্য একটি বিড়ির খুব দরকার এখন। পিচ্চি একটা ছেলেকে চা আর সিগ্রেট বিক্রি করতে দেখে ডেকে আনলো কাছে।

- কি লাগবো সাব? ছেলেটির মুখে চাঞ্চল্যকর হাসি।

- একটা বিড়ি দে।

- সাব বিড়ি তো বেচি না। সিগ্রেট আছে।

- বেনসোন দে একটা। আচ্ছা তোর নাম কি?

- সাব আমার নাম টিঙ্কু। আপনার নাম কি সাব?

- হিমু।

- এটা আবার কেমন নাম?

- হিমাদ্রি আমার নাম। সেটাকে সংক্ষেপে হিমু বলে বন্ধুরা। তুই বুঝবি না। আচ্ছা টিঙ্কু তুই কত দিন যাবত এই কাজ করস?

- সাব মেলা দিন, যহন বাপে মইরা গেল, তহন থেইকা।

- প্রতিদিন কত কামাস?

- সাব মাঝে মধ্যে একশ, মাঝে মধ্যে বেশি ভাল হইলে দেড়শ, দুইশ। সাব আমি ছোডো বইলা কেউ আমার কাছ থেইকা কিনতে চায় না।

- আচ্ছা শোন, আজকে আমি তোর হয়ে চা আর সিগ্রেট বিক্রি করে দিবো। তুই শুধু আমার পেছন পেছন থাকবি। কেমন?

- না, না সাব। আমার একারই হয় না এই টাকায়। আপনারে লগে নিলে আজকের ভাগে কিছুই জুটবো না।

- আরে বোকা আমি ভাগ বসাতে যাবো কেন? আজ সারাদিন তোর হয়ে চা-সিগ্রেট বিক্রি করে যা টাকা পাবো, তার পুরোটাই তোকে দিয়ে দিবো। কেমন? এবার তো রাজি, নাকি?

- জ্বি আচ্ছা। ঠিক আছে উস্তাদ। আপনারে এখন থেকে উস্তাদ ডাকবো। বাজান মরার আগে কইয়া গেছে, যার কাছ থেকে কিছু হইলেও শিখন যায়, তাকে উস্তাদ বইলা ডাকতে। আইজ আমি আপনার কাছ থেকে কেমনে বেচাকিনি করতে হয়, শিখমু।


এক ফ্লাক্স ভর্তি গরম চা আর সিগ্রেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়লো হিমাদ্রি, পেছন পেছন টিঙ্কু হাঁটছে। একে তো পহেলা বৈশাখ, সেই সাথে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভাল বেচা-কিনি হলো। টিঙ্কু তো তার নতুন উস্তাদের কাজ কর্মে পুরাই ফিদা হয়ে গেছে। সে পাড়লে এখনই কদমবুসি করে নেয়।


পার্কে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হিমাদ্রির চোখ থমকে গেলো একটা জিনিস দেখে। আর সেটা দেখে পেছন থেকে টিঙ্কু বলতে লাগলো

- উস্তাদ দাঁড়াইয়া গেলেন যে? কি হইছে?

- টিঙ্কু কিছু হয় নাই। একটা বড় মাছ পাইছি। ধরতে যাচ্ছি, আমার পেছন পেছন আয়।

টিঙ্কু তার উস্তাদের পেছন পেছন হাঁটছে, উস্তাদ কেউ একজনকে লক্ষ্য করে এগুতে থাকে সামনের দিকে। আর সেই আগানোর ভঙ্গী রপ্ত করায় ব্যস্ত টিঙ্কু। তার কাছে এখন উস্তাদ যা করবে, তাই মধু। সে অবলীলায় দেখতে লাগলো, তার উস্তাদ কোন এক অপরিচিতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো-

- সাব সিগ্রেট অথবা চা লাগবো?

লোকটি এমন ভাবে চমকে উঠলো, যেন মনে হয় কাউকে জীবনেও চা বেচতে দেখনি। টিঙ্কু তো খুব উত্তেজিত কি করছে তার উস্তাদ, সেটা দেখার জন্য। লোকটির সাথে একটা সুন্দরী মেয়েও আছে, যাকে কিনা টিঙ্কুর মনেও ধরেছে। টিঙ্কু মনে মনে ভাবছে বড় হয়ে ঠিক এমন একটা মেয়ের সাথে প্রেম করবে, আর এই পার্কে এসে বসে বসে বাদাম খাবে।

- নাহ, কিছু লাগবে না। অনেকটা ভীত গলায় উত্তর দিলো লোকটি।

- নাহ নাহ, কিছু না নিলে তো হবে না। আপনার জন্য না হয়। আপনার পাশে বসে থাকা আপার জন্য হলেও এই চকলেট টা নিতে হবে।

- আচ্ছা দিন, দাম কতো?

- দুইশ টাকা।

- কি?

- হ্যাঁ, দুইশ টাকা। কেন শুনেন নাই?

লোকটা দিব্যি পকেট থেকে দুইশ টাকা বের করে দিয়ে চকলেট হাতে নিয়ে সেখান থেকে দ্রুত উঠে চলে গেলো। টিঙ্কুর শ্রদ্ধা তার উস্তাদের প্রতি আরো বেঁড়ে গেলো কয়েকগুণ। কিভাবে সে এত সহজে একটা চকলেট বিক্রি করে দুইশ টাকা পেলো, সেটা নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। বরং দুইশ টাকা আজ এক জনকে ক্ষেপ মেরেই পেয়ে গেছে, সেটার জন্য তার খুশির ইয়াত্তা নেই। সে সাথে সাথে তার উস্তাদকে কদমবুসি করে নিলো। আর অন্য দিকে হিমাদ্রির মুখে তখন রাজ্যের হাসি। ছোট শালা হৃদ্যকে এই অবস্থায় হাতে নাতে ধরে ফেলবে, সেটা কখনো তার ভাবনায়ও আসে নি। হিমু হবার স্বাদ পেয়ে যাচ্ছে সে।


সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আকাশটাও বেশ মেঘলা। টিঙ্কু আর হিমাদ্রি বটমূলের নিচে শুয়ে আছে। খুব ক্লান্ত দুজনেই। হিমাদ্রি উঠে বসলো। তার হাতে এখন অনেক কাজ। পাশ দিয়ে যাওয়া এক রুটি বিক্রেতার কাছ থেকে অবশিষ্ট চল্লিশ টাকা দিয়ে রুটি কিনে সে ও টিঙ্কু খেলো। আজ সারাদিন যত টাকা উপার্জন করেছে তার সব গুলোটাকা টিঙ্কুকে দিয়ে সে উঠে যাচ্ছে। টিঙ্কুর মুখে হাসি এত গুলো টাকা দেখে। সে আরেকবার উস্তাদকে কদমবুসি করে বিদায় জানালো। হিমু হেঁটে যাচ্ছে আর টিঙ্কু একমনে আজ কত টাকা কামিয়েছে তা গুনছে। সে জানে আগামী এক মাসেও হয়তো এত টাকা কামানো হবে না তার। সে আজ অনেক খুশি। উস্তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় তার চোখের কোণটা চিকচিক করছে, মনে মনে বলছে উস্তাদ আপনি যেখানেই থাকবেন, অনেক ভাল থাকবেন।


প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। হিমাদ্রি আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। কেন যেন রূপার কথা মনে পড়ে উদাস হয়ে পড়লো মন। একটা বিড়ি ফোকানো দরকার এখন। কিন্তু কানাকড়িও পকেটে নেই। রূপার সাথে একবার দেখা করা দরকার। তার মনে হচ্ছে হয়তো যুগ যুগ ধরে  রূপার সাথে দেখা হয় না।


কলিংবেল টিপতেই রূপা দরজা খুললো। তার চোখ লাল হয়ে আছে, মনে হচ্ছে আজ সারাদিন সে কেঁদেছে। হিমু নিয়নের আলোয় দেখতে পেলো তার সারা শরীর হলুদ হয়ে আছে। তার বুঝতে বাকী রইলো না যে দুইশ টাকায় কেনা পাঞ্জাবী থেকে রঙ তো উঠবেই। রূপা তরিগরি করে তোয়ালে দিয়ে হিমাদ্রির মাথা মুছে দিচ্ছে আর হিমাদ্রি বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন