শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২

“ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে”


আমি পরিবারের সব চেয়ে ছোট মেয়ে। আর সব চেয়ে ছোট বলে আদরটা সব সময় একটু বেশিই পেতাম। বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিল স্নো-হোয়াইট, বাংলায় শব্দান্তর করলে দাঁড়াবে বরফ-সাদা বা সাদা-বরফ। বাংলায় শব্দান্তর করার কথার পেছনে কারনও অবশ্য আছে। বন্ধুরা আমাকে “সার” বলে ডাকতো। “সা” এসেছে সাদা থেকে আর “র” এসেছে বরফ থেকে। আমার অন্য আরেকটি পাঠ্যগত নাম ছিল, তা হলো – “স্নিগ্ধা”, নামটা আমার অনেক পছন্দের হওয়া সত্ত্বেও কেউই এই নামে ডাকে না। আর এটা নিয়ে আমার দুঃখের শেষ ছিল না। আমাদের পরিবারে আরো দুইজন মেয়ে আছে। একজন আমার লক্ষ্মী বড় আপু। আরেকটা হল আমার বজ্জাত মেজদি। আমার কোন কথা শুনে না, বরং সারাদিন আমার নামে বাবা-মার কাছে নালিশ দিয়ে বেড়ায়। বজ্জাত একটা। আর আমার বড় আপুটা কত্ত ভাল। কখনো আমাকে বকা পর্যন্ত দেয় না। আমাদের পরিবারের আরো একটা সদস্য আছে, যার সাথে পরিচয় না করিয়ে দিলে পরিচয় পর্বটাই যে বৃথা যাবে, সেই সদস্যটা হলো আমার নাদুশ-নুদুশ টেডি বেয়ার। একদম গুলুগুলু। দেখলেই গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে। ওর নাম হচ্ছে প্রিঞ্চ। প্রিঞ্চ কেন রাখা হয়েছে কেউ কি ধারণা করতে পারছেন? প্রিঞ্চ রাখা হয়েছে, কারন হল স্নো-হোয়াইটের যে প্রিয়তম ছিল, তার নাম ছিল প্রিঞ্চ।



আজ আমার বড় আপুর বিয়ে। বাড়িঘর অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। লাল বেনারসিতে বড় আপুকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আমারও আজ কেন যেন খুব বউ বউ সাঁজতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি আর মেজদি আজ পাল্লা দিয়ে সেজেছি।মেজদি জিজ্ঞেস করলো, কিরে তোকে এত সুন্দর লাগছে কেন রে? আমাকেও তো হার মানিয়ে ফেললিরে তোর রূপের ঝলকানিতে। হেহেহে, তুমি কি আর আমার সাথে পাল্লা দিয়ে পারবে? বলো? বাবা-মা তো আর অযথায় নাম স্নো-হোয়াইট রাখে নি। বলেই খেক খেক করে হেসে দিলাম।


সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে অনেক হৈচৈ বেঁধে গেলো। না না ভয়ের কিছু না। মেয়ে বিদায় পর্ব চলছে আরকি। বাবা-মা কাঁদছে, ঐ দিকে আপুও কাঁদছে। সব মিলিয়ে বেশ কান্নার হাটের মত বসে গেল। বুঝি না, কেন মানুষজন এত কান্নাকাটি করে। আমার বিয়ে হলেও কি আমি ঠিক এইভাবে কাঁদবো? কি জানি!


মেজদির বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেল। ছেলে বাইরে থাকে। দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। ছেলের আব্বু আবার বাবার পরিচিত, তাই হুট-হাট করেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হল। এইবার কিন্তু আর কান্নার হাট বসে নি, কারনটা কি কেউ আন্দাজ করতে পারছেন? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। এইবার তো আর মেজদিকে আমাদের বাসা ছেঁড়ে চলে যেতে হয় নি। তো কাঁদবেই বা কেন? হেহেহে।



অসহ্য!! অসহ্য!! অসহ্য!! অনেকদিন পর বাসায় আসছি, কোথায় বাবা-মা খুশি হবে, তা না। ইনারা লেগে আছে আমাকে পাত্র দেখানোর পাল্লায়। আমি তো সাফ না করে দিয়েছি। এমনিতেই সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, তার উপর ভার্সিটির হলে পড়ালেখার ‘প’ ও হয় না। এই পরিস্থিতিতে কোথায় একটু শান্তিতে ঘুমাবো, তা না। পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেল। সন্ধ্যায় নাকি ছেলের পক্ষ আসবে আমাকে দেখতে। কি যে মেজাজ গরম হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। মেজাজ ঠাণ্ডা করার জন্য দিলাম এক ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো মেজদির ডাকে। - উঠ সারের বাচ্চা!! [ সার, স্যার ভেবে বসে থাকবেন না যেন ] ছেলের বাবা-মা তো এসে পড়েছে। - কি হইছে মেজদি? - আরে জলদি উঠ, ছেলে পক্ষ তো চলে আসছে তোকে দেখতে, তারাতারি কর। - আমি উঠবো না। - শোন, আমার লক্ষ্মী বোন, এখন পাগলামি করিস না। প্লীজ তারাতারি কর। অনেক আকুতি-মিনুতি করার পরও পারলাম না ঐ বজ্জাতটার সাথে। উঠে রেডি হতে বাধ্য হলাম। আপনারা ভাবছেন, কি যেন কি সেজে-গুজে গিয়েছি! তাই না? আপনারা যা ভাবছেন, তা ঠিক না। আমি মোটেও সাঁজ-গোঁজ করেনি। এমনকি আমার নামের অমর্যাদা করে স্নো পর্যন্ত মুখে না লাগিয়েই চলে গেলাম। কি ভাবছেন? ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে? তা তো জানি না, তবে ছেলের বাবা-মায়ের যে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে, তা তাদের তাড়া দেখেই বুঝা যাচ্ছিল। তারা পারলে আগামীকালই আমাদের বিয়ের তারিখ ফেলে দেন।


আজ ছেলেটার সাথে আমার কাবিন হচ্ছে। ছেলেটার পরিবার সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তা হলো, ছেলেরা দুই ভাই। কোন বোন নেই, আর এই জন্যই বাবা-মার ছেলের বউ পেতে এত তাড়া। যার সাথে আজ আমার কাবিন হচ্ছে, তার নাম ইফাদ, যদিও স্বামীর নাম মুখে নেওয়া ভাল না, কিন্তু আমি তো নিতে পারি, ঐ ছেমড়া তো এখনো আমার স্বামী হয় নাই। হেহেহে। ছেমড়া তো বুঝতেছে না, কারে বিয়া করতাছে। পরে টের পাবে কত ধানে কত চাল। ছেলে নাকি ডাক্তার। দেখে অবশ্য আমার তাই মনে হয়েছিল। দেখতে শুনতে মোটেও খারাপ না। যে কোন মেয়ে খুব সহজেই পটে যাবে। ওর ছোট ভাইটার নাম সিজান। ছেলেটা এত্ত সুইট কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাসে অটেস্টিক হয়ে জন্মাতে হয়েছে তাকে। বাবা-মার সবচেয়ে আদরের ছেলে এই সিজানই। আমার জনের কোন দামই নাই। “আমার জন” কি বলতেছি আমি এই সব!!?? আজ কাবিন হওয়ার কথা না। আমাদের ধুম-ধাম করে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মরার পরীক্ষাই তো সব গণ্ডগোল বাঁধাইলো। এই পরীক্ষা কখনই আমার পিছু ছাড়বে না। কোথায় এখন একটু ভাল ভাবে ঘুরাঘুরি করবো, কক্সবাজার যাবো, সেন্টমার্টিন যাবো, তা না পরীক্ষা চলে এসেছে সামনে। পরিক্ষার কারনেই বিয়ের তারিখটা পিছানো হয়েছে। আমার খুব সখ ১৪ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করা। কিন্তু এই মরার পরীক্ষাই সব খাইলো। মানুষের বিয়ে কি দশ বার হয়? পরীক্ষা তাও বুঝে না। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে পরীক্ষা হবে। বিয়ের তারিখ ফালানো হয়েছে ১লা মার্চ। এই নিয়ে আমার দুঃখের কোন কমতিই রইলো না। আমার উনি আবার এর মধ্যে আমাকে সান্ত্বনাও দিতে শিখে গেছেন! উনার অগ্রগতিতে আমি সত্যিই মুগ্ধ। আজ নাকি আবার আবাদার করে বসে, আমার সাথেই থেকে যাবে!!?? কি ভাবছেন? আবদার করেছিল? হ্যাঁ, একদম ঠিক ভেবেছন, ঐ ছেমড়া কিভাবে যেন বাবা-মাকে ম্যানেজ করে ফেলছে, আজ রাতে আমাদের বাসাতেই থাকবে। আজ নাকি আমাদের বাসর রাত!!! আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বুঝার চেষ্টা করলাম, সত্যি কি আমি জেগে আছি? নাকি ঘোড়ের মধ্যে ভাবছি? একটা চিমটি কাটলাম। আরে হ্যাঁ, আমি তো জেগেই আছি। মানে আজই আমাদের বাসর রাত!!


আমি বিছানায় বসে আছি। এই রাতকে নিয়ে প্রত্যেক মেয়েরই অনেক ধরনের আশা-স্বপ্ন থাকে। আমারও কি কোন আশা বা স্বপ্ন আছে? খুব দ্রুত ভাবতে লাগলাম। না, খুঁজে পেলাম না। হয়তো আমার আকাঙ্খা এত ছিল না, যতটা পেয়ে গেছি। মানুষ যখন তার চাওয়ার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়, তখন আর তার কোন আশা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ঐ ছেমড়া ঘরে ঢুকছে। আমার শরীর কেন যেন কাঁপতে শুরু করেছে। আমি কি ভয় পাচ্ছি? ভয় পেলেই বা কিসের ভয়? নিজেকে শান্ত করলাম। ছেমড়াটা আমার পাশে এসে বসলো আর অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো!!! শুনতে চান কি কাণ্ড? আপনি যা ভাবছেন, তা না। ছেমড়াটা আমার হাত, তার হাতের উপর রেখে বেসুরা কন্ঠে গান গাইতে শুরু করলো, আমি হাসবো কিনা কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ গান বন্ধ করে আমার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল- “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে” আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ঐ পাগলটার দিকে।



পরীক্ষা শেষ। বাসায় আসছি গতকাল রাতের ট্রেনে। আজ ঐ ছেমড়াটার সাথে কার্ড সিলেক্ট করতে যাওয়ার কথা। কিসের কার্ড ভাবছেন তো? আরে আমাদের বিয়ের কার্ড। আরে “আমাদের” কথাটা কোত্থেকে আসলো?? 


কার্ডের দোকানে গিয়ে ঐ ছেমড়ার সাথে আমার তুমুল এক ঝগড়া হয়ে গেল। এক পর্যায়ে দোকানের বয়স্ক মালিকটি ঠান্ডা লাচ্চি এনে আমাদের খেতে দিলেন, আর বললেন- বাবারা এই ভাবে ঝগড়া করা কি ঠিক? আপনারা ভাবছেন, আমরা কি নিয়ে এত ঝগড়া করছি? কি বুঝতে পারেন নি? আমাদের বিয়ের কার্ডটি দেখতে কেমন হবে, তা ঠিক করতে গিয়ে। ওর  সাথে আমার রুচির এত অমিল!!! জানলে ওকে বিয়ে করার চিন্তাই করতাম না। ও তো আমার মেজদির চেয়ে হাজারগুণ বেশি বজ্জাত। রাগে গা কটমট করছে। অনেক কষ্টে একটা কার্ড ঠিক করলাম দুইজন মিলে।



পরশু আমাদের বিয়ে আর আজ ঐ বজ্জাত ছেমড়াটা কক্সবাজার গেছে, যাবার আগে বলে গেছে আমার জন্য নাকি সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে। হাইরে বোকা বজ্জাত ছেমড়া, সারপ্রাইজের কথা আগে থেকে বলে দিলে কি আর তা সারপ্রাইজ থাকে? বোকা একটা, কিচ্ছু বুঝে না। হঠাৎ করেই মাঝ রাতের দিকে ফোন বেজে উঠলো, এত রাতে ফোন আসায় খুবই বিরক্ত হলাম। তারপরও ইমারজেঞ্চি কল ভেবে ফোনটা ধরলাম। কি ভাবছেন? আঁতকে উঠেছিলাম? না, আমি আঁতকে উঠি নি, আমি দৃঢ় ছিলাম। তেমন কিছুই তো ওর হয় নি, ছোট খাট একটা দুর্ঘটনা। রাতের অন্ধকারে প্রাইভেট কারটাকে ঘোড়াতে গিয়েই ছোট একটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ডাক্তার বলল তো, তেমন কিছুই হয় নি। আমিও জানি আমার বজ্জাত বোকা ছেমড়াটার কিছুই হবে না। আমার নাম্বারটা নাকি ডায়েল কলে ছিল আমার বোকাটার মোবাইলে। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।


আমার পাশেই আমার পাগল বজ্জাত বোকা ছেমড়াটা শুয়ে আছে। ওর মুখটা কেমন যেন নীলাভ লাল হয়ে আছে। আর তার পাশেই রাখা আছে আমার জন্য আনা সারপ্রাইজটা, আমি দ্রুত খুলে দেখলাম কি সেই সারপ্রাইজ। খুলতেই দেখলাম পাথুরে শামুক দিয়ে খুদায় করা একটা পেইন্টিং। আর তাতে লেখা “ভালবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে” আমার আর বাকি কোন কিছুই মনে নেই।



আপনারা ভাবছেন আমি এখন কি করি? হেহেহে, আপনারা সবাই এত বোকা কেনো? আমি তো আর এই আবদ্ধ জেলখানা টাইপের ঘর থেকে বের হয়ে মন্দির বানাতে পারছি না, তাই আমার খাবার না খেয়ে জমিয়ে জমিয়ে মন্দির বানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু বজ্জাত লোক এসে মন্দির গুলো ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আমার না তখন ভীষণ কান্না আসে। আমার পাগল ছেমড়াটা না আমাকে বলেছিল ভালবেসে তার নামটি নিভৃতে লিখে রাখতে আমার মনেরও মন্দিরে। আমার মন্দির তো ঐ বজ্জাত লোক গুলো ভেঙ্গে ফেলে গো। আমি না তোমার কথা রাখতে পারছি না।

অবাক বিস্ময়ের বান্দরবান


বন্ধুরা মিলে অনেক বাছাবাছির পর ঠিক হলো বান্দরবান যাবো। একে তো পরীক্ষা শেষ, দ্বিতীয়ত এই শহরের যান্ত্রিকতায় কখন যে নিজেও যন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছি টেরই পাই নি। আর এই যান্ত্রিকতার অবসানের জন্যই আমাদের এই অবাক বিস্ময়ের বান্দরবান যাওয়া। 


১৪ মার্চ,রাত ৮.৩০ টাঃ বাসার সবাইকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় উঠলাম। বন্ধুরা সবাই ফকিরাপুল একত্রিত হবো। বাসের টিকেট আগে থেকেই কাটা আছে। রিক্সায় উঠার পর রিক্সাচালকের সাথে আমার কথোপকথনের কিছুটা না বললেই নয়। 


- মামা, এত ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে কই যাচ্ছেন? চট্টগ্রাম নাকি কক্সবাজার? - না মামা, বান্দরবান যাচ্ছি। - বন্ধুরা মিলে যাচ্ছেন? - হ্যাঁ, ভার্সিটির বন্ধুরা মিলে। - মাইয়্যা কয়টা? [ প্রশ্নটা শুনে কিছুটা ইতস্তত হলাম ] - না মামা কোন মেয়ে নাই। মেয়েদের বাবা-মা ওদেরকে যেতে দিবে না। আরো বড় হয়ে নিক, তারপর। [ তছাড়া জেনে শুনে কেন কাঁধে ঝামেলা নিয়ে বেড়াবো? মেয়ে জিনিসটাই যে ঝামেলার ]



১৫ মার্চঃ 


বান্দরবান শহরঃ খুব ভোরেই পৌঁছে গেলাম বান্দরবান শহরে। চারদিকে এখনো কোলাহল শুরু হয় নি। অচেনা শহরের সব কিছুই কেমন যেন অন্য রকম। আর এই অন্য রকম লাগা আরো বেড়ে গেল যখন পুরো বাজার ঘুরেও “মামুন হোটেল” নামের কোন হোটেল খুঁজে না পাওয়ায়। 


আমাদের গন্তব্য এখন রুমা বাসস্ট্যান্ড, ওখান থেকে রুমা ঘাট, এর পর নৌকা বা ট্রলারে করে রুমা বাজার। রুমা বাজারে আমাদের গাইড ঠিক করে রাখা আছে। 


রুমা বাসস্ট্যান্ডঃ বান্দরবান শহর থেকে কিছুটা দূরেই রুমা বাসস্ট্যান্ড। গাড়িতে করে ১০ মিনিট যেতেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। রাস্তায় যেতে যেতে পাহাড়ের মুগ্ধতা দেখে মুগ্ধ হলাম। পাহাড়ের চূড়ায় বাড়ি-ঘর। কখনো ওইভাবে কল্পনাও করেনি। 


রুমা ঘাটঃ রুমা ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পাহাড়ি সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে অবলোকন করার সুযোগ পেয়ে বেশ ভাল অনুভূত হচ্ছিল নিজের মাঝেই। বেশ অনেকখানি (২ ঘন্টা) আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে রুমা ঘাটে পৌঁছালাম। ঘাটে নৌকা ছিল, কিন্তু ইঞ্জিন-চালিত নৌকায় করে গেলে অনেকটা সময় বাঁচবে। তাই অপেক্ষায় রইলাম আর এই অবসরে শুরু করে দিলাম আমাদের চিরচারিত 29 Card খেলা। 


রুমা বাজারঃ ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। নদীটির নাম “সাঙ্গু নদী” নদীর  হীমশিতল পানিতে হাত   রাখা কি যে প্রশান্তির তা সেদিন খুব ভালভাবে অনুভব করলাম। নদীতে ছোট-ছোট ছেলে মেয়েদের সাঁতার কাটতে দেখে নিজেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল নদীতে নেমে পড়ার। কিন্তু তা আর হল না। নদীর স্রোত পাড়ে যখন আছড়ে পড়ছিল, সেটা দেখার মত দৃশ্য ছিল। 


বাজারে পৌঁছাতেই গাইড এসে আমাদের নিয়ে গেল হোটেলে। সেখান থেকে খেয়ে দেয়ে রওনা হলাম বগালেকের উদ্দেশ্যে। 


বগালেক পাহাড়ঃ  জীপে করে বগালেক পাহাড়ের নিচে নামলাম। পাহাড়ের উচ্চতা দেখে সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে উঠা শুরু করলাম। টিভিতে পাহাড়ে উঠা দেখলে মনে হয়, কতই না সহজ, কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। কিছুটা উপরে উঠতে গিয়েই হাঁপিয়ে উঠলাম। একে তো টানা জার্নি, তার উপর অক্সিজেনের সল্পতা। খুব কষ্ট হয়ে গেলো পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে। পাহাড়ের উপর থেকে সব কিছু অনেক ছোট ছোট লাগছিল দেখতে। 


 বগালেকঃ বগালেক পাহাড় থেকে নেমে বগালেক পাড়ায় এক আদিবাসীর বাসায় উঠলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরই চলে গেলাম  বগালেকে গোসলের জন্য। অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছিল লেকটাকে দেখেতে। সামনে দিগন্তজোড়া  বিশাল পাহাড়, তার উপর সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সারাদিনের জার্নিতে শরীর খুব বেশি রকম ক্লান্ত। আর লোভ সামলাতে পারলাম না। নেমে গেলাম লেকে। লেকের পানি এত ঠাণ্ডা ছিল, নিমিষেই সকল ক্লান্তি দূর করে দিল। প্রায় এক ঘন্টার মত পানিতে ছিলাম। এর একটা ঘন্টা সারা জীবনের জন্য সৃতির পাতায় গেঁথে থাকবে। রাতের বেলায় কার্ড খেলা তো ছিলোই


১৬ মার্চঃ কেওক্রাডাং – সকালের নাস্তা করে কেওক্রাডাং এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রথমে অবশ্য ঠিক হয়েছিল পায়ে হেঠেই উঠবো। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে জীপ পেয়ে যাওয়ায়, এতে করেই রওনা হলাম। ভাবতেই অবাক লাগে, এত উঁচু উঁচু পাহাড়ের উপর কি করে গাড়ি উঠে। সত্যিই অকল্পনীয়। 


কেওক্রাডাং এর উপরে উঠে নিজেদেরকে মনে হচ্ছিল অনেক কিছু জয় করে ফেলেছি। তখনো বুঝতে পারি নি সামনে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছিলো। আমাদের ঐদিনের মধ্যেই যাদিপাই ঝর্ণা দেখার কথা ছিল। হাতেও অনেক সময় বাকি। আমরা রওনা হলাম। 


যাদিপাই পাড়াঃ   প্রখর রোদ, আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিই।পথ আর শেষ হচ্ছে না। মনে হয়েছিল খুব কাছেই হয়তো হবে ঝর্ণা। কিন্তু   তা না। প্রায় ৪ ঘন্টা হাটার পর আমরা যাদিপাই পাড়াতে পৌছালাম। ওখানে ব্যাগ রেখে রওনা হলাম যাদিপাই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। 


যাদিপাই ঝর্ণাঃ আমাদের পথ যেন কিছুতেই কমছিল না। প্রায় এক ঘন্টা হাটার পর একটা পাহাড়ের উপড় উঠলাম, আর উঠে যা দেখলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদেরকে পুরো ৯০ডিগ্রি ঢালু একটা পাহাড় নামতে হবে ( স্লোপ [ঢাল] টেন্স টো ইনফিনিটি ), আমরা দেখেই হতাশায় ভেসে গেলাম, এতটা পথ হেটে এলাম, এখন ফেরতও যাওয়া যাবে না। আল্লাহ্‌র উপর ভরসা নিয়ে নামতে শুরু করলাম। বিশ্বাস করতে এখনো ভয় লাগে যে,      আমাদের মধ্যে কারো পা একবার স্থানচ্যুত হলেই সরাসরি পাঁথরের গায়ে পড়ে যেতাম। আর এর ফলাফল সুখকর হত না। প্রায় আধা ঘন্টা লাগিয়ে অনেক সাবধানে নামলাম পাহাড় থেকে। নেমেই যাদিপাই ঝর্ণার দেখা পেলাম। আর দেড়ি করতে পারলাম না। দৌরে নেমে গেলাম ঝর্ণার পানিতে। এত ঠান্ডা হয় ঝর্ণার পানি, তা আগে ধারণা ছিল না। ঝর্ণার মধ্যে গা ভিজাতেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম। চোখ মেলতেই রংধনুর দেখা মেলতো। সে এক অবর্ণনাতীত অভিজ্ঞতা। সেখানে আমরা প্রায় ১ ঘন্টার মত সময় কাটালাম। 


থাইক্ষ্যাং পাড়াঃ যাদিপাই ঝর্ণা থেকে উঠে এসে, যাদিপাই পাড়া হয়ে আমরা রওনা হলাম থাইক্ষ্যাং পাড়ার উদ্দেশ্যে। আমরা রাস্তায় লাঠির মহত্ত্ব বুঝতে পারলাম। লাঠিতে ভর করে করে পাহাড় উঠা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এতক্ষণ পাহাড়ে উঠতে যতটা কষ্ট হচ্ছিলো, তা লাঠির বৌদলতে অনেকখানি কমে গেছে। আমাদের বন্ধু সাদির একটা ডাইলগ না দিলেই নয়-                               “Climbing A Hill Without A Stick Is Very Hard”  


অনেকখানি পথ চলার পর সন্ধ্যানাগাদ আমরা থাইক্ষ্যাং পাড়ায় পৌঁছালাম। পথোমধ্যে “৫ মিনিট” এর একটা গল্প ছিল। এটা নিয়ে আরেকটা গল্প লেখা যাবে। তাই আজ আর আলোচনা না করি। 


থাইক্ষ্যাং পাড়ায় স্কুল ঘরেই আমাদের রাত কাটাতে হল। কিছুটা গল্প আর কার্ড খেলা তো সবসময়ের মত ছিলই। রাতের আকাশ দেখতে বের হয়েছিলাম। এত স্বচ্ছ আকাশ!!! কখনো কল্পনাও করে নি। আকাশের প্রিতিটি তারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে আকাশপানে চেয়ে ছিলাম। 


১৭ মার্চঃ আজ আমাদের লক্ষ্য বাকলাই ঝর্ণা। খুব বেশি দূরে না। ৬ ঘন্টার টানা হাঁটা। তাই আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম। যাত্রা শুরুর কিছু আগেই একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। নিজ চোখে পাহাড়ি মেয়েদের নাচ দেখার সৌভাগ্য হল আমাদের। 


বাকলাই যাচ্ছি। রাস্তায় আমরা সবাই অনেক বেশি রকম ইমোশনাল হয়ে পরেছিলাম। এর পেছনে কারন হলো- আমরা এতটা রিমোট অঞ্চলে চলে এসেছিলাম যে, সচরাচর এখানে মানুষজন খুব কম আসে, তাই রাস্তাঘাট ( মানে পাহাড়ের কিনারের রাস্তা ) অতটা ভাল না। রাস্তায় অনেক আর্মি সিভিলিয়ানদের সাথে দেখা হলো। তাদের মধ্যে একজন তো কেঁদেই ফেলল আমাদের দেখে। তার কথা গুলো আমার কানে এখনো বাজে- “আমরা তো মুখ্য শুখ্য মানুষ, পাহাড়-পর্বতের সৌন্দর্য আমাদের বোঝার ক্ষমতা নাই। আপনাদের মত শিক্ষিত মানুষ এলেই না আমাদের দেশটা পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।” কথাগুলো বলতেই কেঁদে ফেললেন। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, উনি আর যাই হোক, মুখ্য নন



বাকলাই পাড়াঃ পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রায় ৬ ঘন্টা পর আমরা বাকলাই পাড়ায় পৌঁছালাম। ঐদিন প্রথমবারের মত টের পেয়েছিলাম পানি পিপাসা কতটা কষ্টের। সেখানে এক আদিবাসীর বাসায় উঠলাম। উঠেই রওনা হলাম বাকলাই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। 


বাকলাই ঝর্ণাঃ আমরা বাকলাই ঝর্ণায় পৌঁছালাম। আমাদের গাইড আপেল এই ঝর্ণা চিনে না। তাই সাথে করে এক আদিবাসী ছেলেকে নিয়ে আসে। মেজাজটা তখন চরম বিগড়ে যায়, যখন দেখলাম আমরা আগের পথ ধরেই হাঁটছি। আমরা ঝর্ণা আরো ১ঘন্টা পথ পিছনে রেখে এসেছি। বাকলাই ঝর্ণা, দেখার মত তেমন কিছু ছিল না। উপর থেকে পানি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বাতাসে কিছুটা পানি বৃষ্টির মত করে গায়ে এসে পড়ছিল। 



১৮ মার্চঃ আমাদের আজকের লক্ষ্য তাজিওডং এ উঠা। বাকলাই পাড়া থেকে তাজিওডং ৬-৭ ঘন্টা লাগবে। তাই আমরা সকাল সকাল রওনা হলাম। 


বাকলাই আর্মি ক্যাম্পঃ রাস্তায় আর্মি ক্যাম্প ছিল। সেখানে ফ্রেশ হওয়ার গেলাম। আর যতটুকু আতিথীয়তা পেলাম, তা সত্যিই ভুলার নয়। 


তাজিওডং এর চূড়াঃ অনেক রোঁদে পুড়ে আমরা যখনই  তাজিওডং এর চূড়ার খুব কাছাকাছি চলে এলাম, তখনই প্রচণ্ড বেগে বাতাস বয়তে শুরু করলো। সে এক অবিশ্বাস্য ভাললাগা। তাজিওডং এর চূড়ায় উঠলাম। উঠেই এত দিনের সব কষ্টগুলোকে সার্থক মনে হচ্ছিলো। আমরা একদম মেঘের সাথে লেগে যাচ্ছিলাম। প্রচন্ড বাতাস আমাদেরকে পারলে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি আর বাতাস, অসম্ভব রকম ভাললাগা কাজ করছিল তখন। কিন্তু এটা খুব বেশিক্ষণ দীর্ঘস্তায়ী হল না। বৃষ্টিতে পাহাড়ের ঢালু রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। তাই আমাদেরকে সেখান থেকে নেমে আসতে হয়। কিন্তু যতক্ষণ ছিলাম তাজিওডং এর চূড়ার উপর, তা হয়তো অন্য কোন অনুভুতির সাথে তুলনা করা যাবে না। 


শেরখর পাড়াঃ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই আমরা পাহাড় থেকে নামলাম। নেমে শেরখর পাড়ায় আশ্রয় নিলাম আজকের দিনের জন্য। সন্ধ্যায় গানের আসর বসলো। দুর্জয় শুরু করলো গান আর তা পুরো পরিবেশটাকে মুখোর করে তুলল। 


১৯ মার্চঃ আজ আমারা থানচি হয়ে বান্দরবান শহরে বেক করবো। তাই রওনা হলাম। আজকের রোঁদটা একটু বেশিই। আর পাহাড়ও অনেক বেশি খাঁড়া এবং উঁচু। প্রায় ১০-১২ টা খাঁড়া খাঁড়া পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমাদের থানচি পৌঁছাতে হয়েছে। আজকের জার্নিটা অনেক বেশি দীর্ঘ লাগছিলো ( প্রায় ৬-৭ ঘন্টা) এত দিনে শরীর তো পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিলোই, তার উপর আজকের এই প্রচন্ড রোঁদে পুরোপুরি জংলী মানব হয়ে থানচি পৌঁছালাম। 


থানচিতে ৫ মিনিটের মত থেকেই বাস ধরার জন্য বের হয়ে যেতে হয়েছে। বাসে করে আমরা বান্দরবান শহরে পৌঁছালাম। পথোমধ্যে নিলগিরি,চিম্বুক আর শৈলপ্রপাত দেখে গেলাম। থানচি থেকে বান্দরবান আসার পথটা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা। আর সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যে ভুবন ভুলানো দৃশ্য দেখলাম, তা সত্যি মনে রাখার মত। 


২০ মার্চঃ আজই বান্দরবানে আমাদের শেষ দিন। আজ স্বর্ণমন্দির দেখেই রওনা হবো। মন্দিরটা ছিল দেখার মত। সোনালী রঙে রাঙ্গা ছিল মন্দিরের চারপাশ। 


আমাদের বন্ধুরাঃ আবীর, দুর্জয়, সজীব, সাদি, একরাম, অর্ণব এবং আমি 


শিক্ষাঃ এই ট্যুর থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। দেশের প্রতি ভালবাসার একটি জ্বলন্ত উদাহরন আমরা দাঁড় করাতে পারি। 


কিছু কথাঃ মানুষের জীবন কতটা কষ্টের হতে পারে, তা এই বান্দরবান না আসলে অনেকটায় বোঝার সাধ্যের বাইরে থেকে যেত। আর গ্রামগুলো পুরোই ছবির মত। এই রকম সৌন্দর্য বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ আছে। 


অতিরিক্তঃ পানি পিপাসা এবং ক্ষুদা কি জিনিস, তা উপলব্ধি করতে হলে বান্দরবান অবশ্যই অবশ্যই একবার গিয়ে ঘুরে আসবেন। 


আরো অনেক কিছু লেখার ছিল। কিন্তু লিখলাম না। কিছু কথা নিজেদের স্মৃতির পাতায় আগলে রাখলে মন্দ হয় না। 
ফোটো কার্টেসিঃ অর্ণব বনিক ( অসাধারণ ফটোগ্রাফার )