শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

অঙ্কুর.........।।


ভোর ৪ টা, প্রতিদিনকার মত আজও দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেলো সাদাতের। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। চোখ বড় বড় হয়ে কোটর থেকে বের হয়ে যেতে চাঁচ্ছে, মুখ থেকে সাদা আঠালো জাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে আর হাঁপানি রোগীর মত অঙ্গভঙ্গি করে মাথাটা এদিক-উদিক দোল খাচ্ছে, মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা এই ছোট্ট মাথাটার ভেতর এসে ভর করছে। চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, কোথাও কোন আলো নেই। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাথার যন্ত্রনায় খাটের পাশে রাখা পানির গ্লাস পর্যন্ত হাত যাচ্ছে না। দুঃস্বপ্নের রেশ কাঁটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে পুনরায় সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। নিঃশ্বাস নেওয়া থেকে শুরু করে মাথায় যন্ত্রণা পর্যন্ত সব আবার স্বরূপে কাজ করতে শুরু করবে। ঘুম ভাঙ্গার পরের পর্যায় থেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসাতে ঠিক দশ মিনিট সময় লাগে। এই দশ মিনিট সাদাতের কাছে অনন্তকাল মনে হয়। আর এক অনন্তকালের যন্ত্রণা শেষে আবার ঘুমোতে যাবে সে।


বর্ষাকাল!!! বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সাদাতের বাবা, জয়ন্ত বৃষ্টির কারনে আজ অফিসে যেতে পারে নি। একই কারনে আজ সাদাতেরও স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাসায় বাবা আর মাকে নিয়ে সাদাতের বসবাস। ছুটির দিনগুলো ব্যাতীত অন্যান্য দিনগুলোতে পরিবারের সাথে ভাল সময় কাটানোর সুযোগ হয়ে উঠে না জয়ন্তের। অধিকাংশ সময়ই অফিসের কাজে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এদিকে স্বামী-সন্তানকে একসাথে পেয়ে সাদাতের আম্মু, সৌমিতার খুশির অন্ত নেই, সারাদিন কখন কি রান্না করবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে। আর সেই সুযোগে বাবা আর ছেলে মিলে বৃষ্টিতে ভেজার প্ল্যান করে ফেলেছে। প্ল্যানে অবশ্য সৌমিতাও রয়েছে। সৌমিতাকে একবার বলা হবে, যদি না রাজি হয় তবে বাবা আর ছেলে মিলেই নেমে যাবে বৃষ্টিতে। তবে আরেকটা ব্যাপার রয়েছে, সেটা হলো সৌমিতাকে এই প্ল্যানের কথা জানানোর সাহস বাবা কিংবা ছেলের কারোরই হচ্ছে না। তারা জানে, সৌমিতা বৃষ্টিতে ভেজা একদম পছন্দ করে না, কারন তার ধারণা বৃষ্টিতে ভিজলেই শরীরে জ্বর চলে আসে। এর পেছনে অবশ্য ছোট বেলায় বৃষ্টিতে ভিজে টানা সাত দিনের জ্বরে ভোগার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সৌমিতার। এরপর থেকে আর কখনই বৃষ্টির আশেপাশেও যায় না সে। তাই বরাবরের এবারও হয়তো তাদের একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা হবে না। এই ভেবেই সাদাতের হাস্যজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ-ই কেমন যেন ফ্যাঁকাসে হয়ে এলো।


সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। জমিসংক্রান্ত কিছু ঝামেলায় পড়ায় দ্রুতই গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জয়ন্ত, তাছাড়া অনেক দিন যাবত গ্রামে যাওয়া হয় না, এই সুযোগে গ্রাম থেকেও ঘুরে আসা যাবে। গ্রামে তেমন কেউ নেই জয়ন্তের। দূর সম্পর্কের এক চাচাই সব জমিজমার দেখা-শুনা করে আসছেন এতদিন যাবত। হঠাৎ-ই চাচার মৃত্যুর খবর আসে, আর সেই জন্যই মূলত অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নেয় সে। আজ রাতের লঞ্চের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু এই বৈরি আবহাওয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কিভাবে বের হবে এই নিয়ে চিন্তায় পরে গেছে জয়ন্ত। আর অন্যদিকে সৌমিতা ব্যাগ গুছানো নিয়ে ব্যস্ত। সাদাত তার দশ বছরের জীবনে লঞ্চে চড়েছে মাত্র তিনবার, তাও শেষ বার যখন চড়েছিলো, তখন তার বয়স ছিলো ছ’বছর। তাই লঞ্চে উঠার অভিজ্ঞতা তার তেমন মনেও নেই। তাই আজ লঞ্চে করে গ্রামে যাওয়ার উত্তেজনাটা তার মধ্যে যেন একটু বেশিই কাজ করছে। সারাদিনের ঝুম বৃষ্টির পর সন্ধ্যায় বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমে যাওয়ায় জয়ন্ত, স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে লঞ্চের উদ্দেশ্যে সদরঘাট রওনা হয়।


হঠাৎ ঝাকুনিতে কেবিনের এক কোণে জ্বলতে থাকা সোডিয়াম বাতিটি সশব্দে নিভে গেলো। কেবিনের জালানা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বৃষ্টির প্রকটতা দেখে সৌমিতা চমকে উঠলো। পুরো কেবিনটা কেমন যেন শীতল হয়ে আছে। সে তার দশ বছরের ছেলেকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, যাতে করে এই বৈরি আবহাওয়ার কোন প্রভাবই এই ছোট্ট আদরের ছেলের উপর না পড়ে। জয়ন্ত বাইরে কি হচ্ছে তা জানার জন্য কেবিন থেকে বের হয়, তাছাড়া বাতিটারও কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। বাইরে প্রচণ্ড শব্দে ঝড় হচ্ছে। ঝড়ের তীব্রতার কারনে নদীর উপর লঞ্চ চলাচল আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। লঞ্চকে নদীর এক পাশে এনে কোন রকমে ভিড়িয়ে রাখেছে লঞ্চ কর্মীরা। লঞ্চে ডেকের উপর শুয়ে বসে আছে শত শত মানুষ, আর তাদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। জয়ন্ত একবার বাইরের দিকে তাকালো, নদীর পাড়ের গাছগুলো বাতাসের তীব্রতায় মনে হচ্ছে এখনই ভেঙে লঞ্চের উপর এসে পড়বে, হঠাৎ এক অজানা আতঙ্ক এসে জয়ন্তকেও আতঙ্কের রাজ্য থেকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো। জয়ন্ত নির্বিকার ভঙ্গীতে কেবিনের দিকে হাঁটা দিলো। লঞ্চের ছাঁদ থেকে বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দ আসছে। কেবিনের ভেতরটা কেমন যেন আরো শীতল হয়ে যাচ্ছে, সৌমিতা তার দশ বছরের ছেলেটাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বৃষ্টির শব্দ সবসময়কার মত এবারও জয়ন্তকে ঘোরের মধ্যে ফেলে দিলো। ঘোরের বসেই সে গাইতে শুরু করলো বৃষ্টির গান.........

যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।

এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।

যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
……………………………………………………………………………………………………………



 হঠাৎ-ই বাইরে খুব হট্টগোল শোনা যাচ্ছে, হট্টগোলের শব্দে সাদাতের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়িতে ঠিক চারটা। খুব শীতে কঁপুনি দিয়ে উঠছে সে। কেবিনে কেউ নেই, না বাবা, না মা। সে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে কেবিন থেকে বের হলো। ঐতো দূরে অনেক লোকের ভিড়ে বাবাকে দেখা যাচ্ছে। আর মা! সে দ্রুত ভিড় ঠেলে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কোন এক ডাক্তার ধরনের লোক ডেকের উপর সৌমিতাকে শুইয়ে প্রেসার মাপছে। সৌমিতার মুখ থেকে অনর্গল সাদা আঠলো জাতীয় পদার্থ বের হচ্ছে আর হাত-পা বাঁকা করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো সে। অনেক লোক এসে ভিড় জমিয়েছে তার চারপাশে। খুব অস্বস্তি লাগছে তার, বারবার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাঁপানি রোগটা তার সাথে ছোট বেলা থেকেই, কিন্তু আজ হঠাৎ করে এইভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, সে ভাবতেও পারে নি। সাথে করে ইনহেলারও আনতে ভুলে গেছে সে। বারবার সে জয়ন্তের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো, সে মুখটাতে অসহায়ত্ব আর অন্যায়বোধের ছাপ। জয়ন্ত কেন যে মনে করে ইনহেলারটা আনতে বলে নি সৌমিতাকে, সেই অন্যায়বোধ। সে তো জানতই যে তার সৌমিতাটা কতটা ভুলোমনা। জয়ন্তের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৌমিতা, আর সাদাতকে নিজের কাছে টেনে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো সে। সাদাত জানে না, তার মা তাকে সারা রাত আগলে রেখেছিলো, কেননা সৌমিতা জানতো ঐ বৈরি আবহাওয়াই তার ছোট্ট ছেলেটার, ছোট্ট শরীরে হাঁপানির যে বীজ আছে, তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। জয়ন্তকে পাশে টেনে মলিন হাসি হেসে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে লাগলো সে। হয়তো বলেছিলো, তার সন্তানটাকে যেন মায়ের আর বাবার আদর দিয়ে সারা জীবন আগলে রাখে। জয়ন্তের চোখে পানি, গাল ভিজে গেছে পানিতে। এটা দেখে সৌমিতার খুব কষ্ট হচ্ছে। জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে সে, বলতে গিয়ে ধীরে ধীরে চোখটা বন্ধ করে ফেলল সৌমিতা।


 ঘড়িতে ৪ টা বেজে ৫ মিনিট। আর ঠিক ৫ মিনিট পরই সাদাতের সকল ইন্দ্রিয় পুনরায় ঠিক মত কাজ করা শুরু করবে। সেদিনের ঐ ঘটনার পর থেকে প্রায় রাতের ঠিক ৪ টায় সাদাতকে একবার করে এই অনন্তকালের বেদনা পোহাতে হয়। সে বসে থাকে সেই অনন্তকালের শেষ দেখার আশায়......।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন