বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১১

নোনা প্রতিধ্বনি

এই শুভ্র উঠ ঘুম থেকে,অনেক তো ঘুমালি,এখন একটু চোখ মেল,ক্লাসের জন্য দেরী হয়ে যাবে যে। উঠ বলছি। আর তুমিই বা কি রকম পিতা বলতো। ছেলের ক্লাস আছে,আর তুমি ঘুমুচ্ছো ছেলেকে নিয়ে। তোমাদেরকে নিয়ে আর পারি না। ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল পিতা-পুত্রের মাঝখানে। আর স্মৃতির পাতা আউড়াতে লাগলো।

এই শুভ্র তোর কি সেই প্রথম স্কুলে যাওয়ার কথা মনে আছে? তুই কতই না কেদেছিলি ঐদিন। বোকা ছেলে আমার। আমি তোকে অনেক বুঝিয়ে নিয়ে গেলাম। আর তুই আমার মাঝের আঙ্গুলটা তোর ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে টিপটিপ পা ফেলে চলেছিলি আমার সাথে। আর ক্লাসে ঢুকে তুই তো ভয় পেয়ে বের হয়ে এসেছিলি, আমিই তো তোকে ক্লাসে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মনে পড়ে তর ঐ দিনের কথা? মনে আছে রাজু নামের একটা ছেলে তোকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে পালাত। আর তুই গাল ফুলিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতি। আমার নাদুশ-নুদুশ সেই ছেলেটা এখন কত বড় হয়ে গেছে!!!

পুরনো দিনের কথা বলতে বলতেই মুখে হাসির ছাপ আর চোখের কোণায় পানি জ্বলজ্বল করে উঠলো। চোখ মুছে আবার বলতে লাগলো,যেদিন তুই প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টফুলে বৃত্তি পেলি, সেইদিন আমি আর তোর বাবা কতই না খুশি হয়েছিলাম। তুই দৌড়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলি। তোর বাবার চোখ দিয়ে অনবরত ফোটায় ফোটায় পানি ঝরছিল, তোর বাবাকে আমি সেই প্রথম কাঁদতে দেখেছিলাম। আর তোর বাবা কি করলো,উল্টো আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো "তুমি কাঁদছো কেন? আমাদের ছেলে যে বৃত্তি পেয়েছে, এতে তো খুশি হবার কথা।" আমি হেসে বলতে লাগলাম, তাহলে তুমি কেন কাঁদছ?!?!?!


আর এই তুমি আমার কথা শুনে হাসছো?!?!?!
প্রথম যেদিন আমাকে প্রপোজ করতে এসেছিলে তখন তো হাত-পা অনবরত কাপাচ্ছিলে। আর আমার সব বান্ধবীরা তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আর হাসবেই বা না কেন? তুমি কি পরিস্থিতিটাই না তৈরি করেছিলে। হাতে একটি লাল গোলাপ নিয়ে রাস্তায় একটি মেয়ের সামনে দাড়িয়ে ঐভাবে কাঁপতে থাকলে তো,যে কেউই হেসে ফেলবে। পাগল একটা!! জানো আমিও না হেসেছিলাম তোমার ঐ পাগলামি দেখে। একদম বোকা স্বভাবের ছিলে তুমি। তবে এখনও তো কম বোকা নউ। কথা গুলো বলতে বলতে চোখগুলো ভিজে গেলো লাবণ্যের।

তোমার মনে আছে সেই দিনের কথা, আমারা প্রথম যেদিন একসাথে বের হলাম। বিকেলের খানিকটা রোদ আমাদের উপর ঠুকরে পড়ছিল। আর আমরা জলের উপর বাতাসের নাউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। ধমকা হাওয়ার পাল বেয়ে চলে যাচ্ছিলাম অসীমে, আর আমি বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলাম তোমাতে।তোমার ঐ চোখে। তুমি আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলে ছলছল নদীর ঐ পানি ছিটিয়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ তুমি আমার হাতটি শক্ত করে ধরলে,আর তুমি কি করেছিলে মনে আছে? ত্মি  আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললা,আমার হাতটি কখনো ছেড়ো না।

চল্লিশ বছর পেড়িয়ে গেছে,লাবণ্য এখন বৃদ্ধা। তারপরও রোজ তার স্বামী আর ছেলের কবরের পাশে বসে পুরনো স্মৃতি তাড়া করে আসে। বাবা যুদ্ধে যাচ্ছে, তা দেখে যে তার নাইনে পড়ুয়া ছেলেটাও বায়না ধরলো যুদ্ধে যাবে বলে। তার আবদার কখনো বাবা-মা ফেলতে পারে না। পুত্রকে সাথে নিয়েই চলে গেলো যুদ্ধে। যাবার আগে লাবণ্যকে বলে গেল-"আমি আসবো তোমার শুভ্রকে সাথে নিয়ে, আর তোমার জন্য স্বাধীন একটা দেশ উপহার নিয়ে আসবো।" তারপর লাবণ্যের কানের কাছে এসে সেই প্রথম দিনের মত  ফিসফিস করে বললা,"আমার হাতটি কখনো ছেড়ো না কিন্তু।"

লাবণ্যের চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে। আর বিড়বিড় করে বলছে,ওগো,তোমার হাতটা আমি আজো ছাড়ি নি।