বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১২

“অঝর-শ্রাবণ-ধারা"


                      অঝর-শ্রাবণ-ধারা
                                                         
                                                          



ojhor srabon dhara.jpg



কিছু কথাঃ
“অঝর শ্রাবণ” গল্পে আপনাদের অভূতপূর্ব সাড়া দেখে আমাদের মনে হলো যে, অঝর এবং শ্রাবণকে নিয়ে নতুন কিছু আপনাদের কাছে তুলে ধরা উচিত। আর এই প্রেক্ষিতেই শুরু হলো অঝর শ্রাবণ ধারা”র দশ পর্বের ধারাবাহিক গল্প।  



 ojhor srabon dhara.jpg      “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (১ম পর্ব)
                                   ||অঝরের কথা---||

[
পনাদের সবার মনে নিশ্চয় একি প্রশ্ন অঝর শ্রাবণ পালিয়ে কোথায় গেল? পালিয়ে গিয়েই বা কি করছে? অঝরের বাবা-মা ওদের পালিয়ে যাওয়া মেনে নিল কিনা? নাকি ওরা দুজন একে অপরের হাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে? আবার অনেকে হয়তো ভেবে নিয়েছেন যে ওরা পালিয়ে কক্সবাজার, বান্দরবান বা সীমান্ত কোন এলাকাই চলে গেল কিনা? এত এত প্রশ্নের বেড়াজাল এবং রহস্যের উন্মোচনের লক্ষ্যে এসে দাঁড়ালাম আপনাদের সামনে।] 

মি অঝর। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলে খুব বেশি আদরের। শ্রাবণ নামের এক মেয়ের সাথে পরিচয়, ওকে পাত্রী হিসেবে দেখতে গিয়ে। এরপর অনেক কাহিনীর পর বন্ধুত্ব এবং সব শেষে বিয়ে বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে পালায়ন। এবার শুনুন পরের ঘটনা।

অনুভূতি কত প্রকার সেটা আমার জানা নেই, কিন্তু এক মিশ্র অনুভূতির মধ্যে দিয়ে সময়গুলো কেটে যাচ্ছে। কিছুটা শঙ্কা আর কিছুটা ভাললাগার ঘোরের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হল গত কয়েক ঘন্টা। 

কিছু বুঝে উঠবার আগেই টের পেলাম আমি ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করছি আর আমার পাশের সিটে শ্রাবণ বসা। খানিকটা কাপুরুষতা আর অনেক বেশি প্রাপ্তির আনন্দ, দুইটি ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি কাজ করছে এক সাথে। তবে প্রাপ্তির আনন্দটায় মনে হচ্ছে বেশি। রবী ঠাকুরের সেই গানটা কেন যেন নিজের অজান্তেই গুনগুন করতে লাগলাম-

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে,
দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি-- পেয়েছি আঁধার রাতে॥
না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো--
তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে॥ 

কিছুক্ষণ পরপর জ্যামের মাঝে পড়লেই ওর চোখের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকি। চোখটা কেমন যেন চিকচিক করছে, ঠিক যেন সূর্যের আলোয় চোরাবালির মধ্যে একচিলতে পানি যেভাবে চিকচিক করে উঠে, সেই ভাবে। আর সেই চোরাবালিতে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। 

বারবার হিমেলকে ফোন দিয়েও পাচ্ছি না, মেজাজটাই বিগড়ে যাচ্ছে। এমনিতেই তো অকাজে সারাদিন প্যান প্যান করে। মাঝে মাঝে ওর প্যান-প্যানানি শুনে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে যাই। কিন্তু কাজের সময় হলেই ওকে খুজেই পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই ফোন দিতে হলো আনিকাকে, ওকে বললাম হিমেলসহ আরো চারটাকে সাথে করে নিয়ে আসতে, ধানমন্ডি কাজী অফিসে। 

ড্রাইভ করছি প্রাপ্তির আনন্দ নিয়ে। ধানমন্ডি লেকের পাশে আসতেই গাড়ি থামাতে বলল শ্রাবণ। ওর নাকি এই সন্ধ্যা-রাতে রাস্তায় হাঁটার শখ জেগেছে। কত করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম এই বউয়ের বেশে রাস্তায় হাঁটা কেমন দেখবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। অনেক অনীহা থাকা সত্ত্বেও ওর জেদের কাছে হার আমাকে মানতেই হল। গাড়িটা রাস্তার একপাশে পার্ক করেই হাঁটা দিলাম। 

ফুটপাতের উপর দিয়ে হাঁটছি দুজন। কিছু উৎসুক চোখ আমাদের দেখছে। কিছুটা বিব্রতও লাগছে বটে। তবে শ্রাবণের জেদটাই এখন মুখ্য। ওর চোখের কোণে কিছুটা জল। ও কি কাঁদছে? নিজেকে কেন যেন খুব করে বকে দিতে ইচ্ছে করছে। আমি জানি ও আমার জন্যই কাঁদছে। ইচ্ছে করছে ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। আর ওর সব দুঃখগুলো নিজের করে নেই। ওর কান্নার রেশটা থামানোর জন্যই বলা-
এতো কি ভাবছো?”
আমাকে তো বাসা থেকে ভাগিয়ে নিয়ে এলে। এখন তুমি কি করবে সেটাই ভাবছি। 
এর মধ্যে এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। এখন আমি তোমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে যাবো এবং আগামী প্রত্যেক বছর এইদিনে আমরা আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করবো। বুঝেছো?”
কথাগুলো শুনে শ্রাবণ কেমন যেন ভাবনায় হারিয়ে গেল, তাকিয়ে রইলো অপলক আমার দিকে। কি ভাবছে ও? আমি এতটা পাগল সেটা? 

ছোট বেলা থেকেই অনেকটা একা একা থাকতে হয়েছে আমাকে। একমাত্র ছেলে বলে আদরেরও কমতি ছিল না, তবে সব সময়ই একাকীত্বের বেড়াজালে আটকা পড়ে থাকতে হত, কিছুটা বন্দীদের মতই। বাবা চাকরীর কারনে সব সময় বাড়ির বাইরেই থাকতেন আর আম্মু থাকতো ঘর সামলাবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে সময় দেয়ার মত কেউ ছিল না। তাই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি বই পড়ে আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে। বন্ধু-ভাগ্য মাশাল্লাহ ভালই বলা চলে, এখনো আড্ডা আমাকে ছাড়া জমে না। তবে একাকীত্বতা সব সময় নিজের মাঝেই বিরাজ করে। অনেকের ভিড়েও একাকীত্ব গ্রাস করে রাখে আমায়। আর এই একাকীত্বকে ঘোচানোর জন্যই হয়তো শ্রাবণের আবির্ভাব আমার রোদে পুড়ে ঝলসে যাওয়া জীবনে। ভাবতেই কেন যেন চোখের কোণটা ভিজে এলো। 

ধানমন্ডি কাজী অফিসে বসে আছি। কাজী যেন কি কাজে একটু ভিতরের রুমে ঢুকেছে। আর এই ফাঁকেই শুরু হয়ে গেছে হিমেলের বকবকানি। কেন ওকে আগে শ্রাবণের কথা জানালাম না, কেনই বা হুট করে বিয়ে করছি, কেন ও বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রীর অংশ হতে পারলো না ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ছেলেটার বুদ্ধি-জ্ঞান যে কবে হবে আল্লাহ-মালুম। নতুন ভাবীর সামনেও কি কেউ এইভাবে কথা বলে। আল্লাহ ওরে হেদায়েত করো। আমিন ।।।

গাড়িতে বসে আছি, শ্রাবণের কান্না যেন থামছেই না। কি করি বুঝে উঠতে পারছি না। আর আমি অসহায়ের মত বসে থাকার পাত্র নই। তাই শ্রাবণের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললাম- 
বউ, তোমাকে অনেক ভালবাসি। 
কিন্তু এতেও ওর কান্না থামছে না, কি করা যায় ভেবে হুট করেই ওকে একবার হাগ করলাম আর মজা করার ভঙ্গিতে বললাম-
আজকে আর কতবার কাঁদবা? গাড়ির টিস্যু বক্সে কিন্তু বেশি টিস্যু নাইবলেই হাসতে লাগলাম। 
ও কিছুটা ইতস্তত হয়ে বলল-
ঢং না করে, গাড়িটা স্টার্ট দাও।আর আমার প্রতিউত্তর ছিল পাগলী 

বাসায় আম্মুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আম্মু কিছুতেই শ্রাবণকে বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। আম্মুর একই কথা, 
এই মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। 
কি করবো বুঝতে না পেরে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আম্মুর সামনে দিয়েই ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। বের হতেই আব্বুকে পেয়ে গেলাম। কি এক কাজে যেন বাইরে ছিল সারাদিন। আমাদের একসাথে দেখে আব্বু খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া সব কিছুই বললাম আব্বুকে। আব্বু সব কথা চুপ করে শুনে শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 

তোমার আম্মুর ব্যবহারে কিছু মনে করো না মা। আসলে অঝরের বিয়ে নিয়ে ওর অনেক রকম চিন্তা ভাবনা ছিল তো, তাই...

শ্রাবণ শান্ত কণ্ঠে বলল,
আমি কিছুই মনে করিনি, আব্বু। 
এই মেয়েটা এত সুন্দর করে কীভাবে আব্বু ডাকে, ভেবেই হেসে দিলাম। এর মাঝেই আব্বু আমাকে বললেন, 
আপাতত শ্রাবণকে নিয়ে আমাদের বাংলো বাড়িটায় ওঠ। তোর আম্মুর কথা ভাবিস না, আমি তোর আম্মুকে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবো।

আমরা বাংলো বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাংলো বাড়িটি আমার কাছে অনেক স্মৃতি বিজড়িত। বাড়িটির নামকরন করা হয়েছে আমার নামে অঝর ভিলা।যখন আমি খুব ছোট তখন থেকেই নির্জনতা আমার খুব আপন। তাই আব্বু আমার এক জন্মদিনে আমাকে এই বাড়িটি উপহার দেন। ছোট ছিলাম, তাই এখানকার সব কিছুই আমাকে মুগ্ধ করতো !!! আমি অবাক হয়ে এই মুগ্ধতার সাগরে ভেসে যেতাম।
বাড়ির পাশ দিয়েই একটি নদীর অববাহিকা বহমান। বাড়ির চারপাশে নানান ধরনের গাছের সমাহার। তুলসী গাছ থেকে শুরু করে বট গাছ, সবই আছে এখানে। আর পাখির কিচিরমিচিরে তো মাঝে মাঝে ঘুমানোও দায় হয়ে পড়ে। ভর দুপুরের ঘাম ঝরানো রোঁদেও বাড়ির আঙিনা শীতল ছায়ায় ভরপুর থাকে। 
বাড়িটা কিছুটা গ্রামের দিকে হলেও এর সৌন্দর্যর কাছে এই বিষয়টা সত্যিই বেমানান। তাইতো ছোটবেলা হতেই কোন সুযোগ হলে ছুটে চলে আসতাম এখানে। নৌকায় করে নদীর বুকে ঘুরে বেড়াতাম, শাপলা তুলে নৌকা ভরে ফেলতাম। সন্ধ্যা নামতেই নদীর পাড়ে বসে সূর্য ডোবার অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করতাম।
রাতের আকাশে চাঁদের আলোয় পুরো বাড়িটাকে কেমন যেন স্বপ্নপুরী মনে হত আমার কাছে। দোলনায় চড়ে দোল খেতে খেতে আকাশের তারা গোনা আমার পুরনো দিনের অভ্যাস। সবই কেমন যেন আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হত।

বাড়ির গেটে ঢুকতেই মতিন মিঞ্চা এসে দাঁড়ালো। শ্রাবণকে সাথে করে নিয়ে গেল বাড়ি দেখাতে। শ্রাবণ কেমন যেন অবাক হয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। 
এভাবে কি দেখছ শ্রাবণ? আগেও তো একবার এখানে এসেছিলে, কদম ফুল নিতে। মনে নেই?”
থাকবে না কেন? অবশ্যই মনে আছে।
তাহলে আজ এতো অবাক হয়ে কি দেখছ?”
সেদিন এটা শুধুমাত্র তোমাদের বাংলো বাড়ি ছিল। আর আজ থেকে এখানে আমাদের সংসার জীবনের শুরু হচ্ছে। তাই সবকিছু একটু বেশি ভালো লাগছে। তুমি এসব বুঝবা না।
এই বলেই ও পুরো বাড়িটি পুনরায় ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো আর মুগ্ধ হতে লাগলো, যেমনটা আমি হতাম আমার শৈশব-কৈশোরে। আমিও আর ওর মুগ্ধতায় ব্যাঘাত ঘটালাম না। 

চাঁদনী রাতে এক সাথে বসে দোলনায় দোল খাচ্ছি দুজন। শ্রাবণ আমার হাতটি ওর কোলের উপরে রেখে আমার কাঁধে মাথা রেখে, কিছুটা হেলান দিয়ে আছে আমার উপর। কোমল মৃদু বাতাস আমাদের স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার। সুখের ভেলায় ভেসে যাচ্ছি আমি। শ্রাবণ কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো
এই শোনো, আমার একটা আবদার রাখবা?” 
কি আবদার শ্রাবণ?”
আগে বলো, রাখবা...
তোমার কোন আবদার আমি না রেখে পারি?”
আচ্ছা তাহলে শোনো। তোমাকে আমাদের জন্য একটা ট্রি হাউজ বানাতে হবে।
ট্রি হাউজ!!
হ্যাঁ, ট্রি হাউজ। জোছনা রাতে আমি তোমার সাথে সেই ট্রি হাউজে বসে জোছনা গিলবো।
আচ্ছা পাগল মেয়ে তো তুমি!!
বানিয়ে দিবা তো?”
বউয়ের কথা কি অমান্য করা যায়, লক্ষ্মীটি??” 

আমি শ্রাবণের হাতটি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আরেকবার, অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে ও কিছুটা লজ্জা পেয়েছে, তাইতো কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকেই আকাশের পানে চোখ ফিরিয়ে নিল আমার বউ, হ্যাঁ আমার বিয়ে করা বউ, আমার সোনা বউ। পৃথিবীর সব সুখ যেন আজ আমার হাতের মুঠোয়, আর আমি তার সবটুকু নিজের করে নিচ্ছি, ঠিক যেন স্বপ্ন ছোঁওয়ার মতো...






ojhor srabon dhara.jpg        “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (১ম পর্ব)
                                  ||শ্রাবণের কথা||
ই মুহূর্তে আমি অঝরের হাত ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। রাস্তার এক পাশে অঝরের গাড়িটা পার্ক করা আছে। আমিই জোর করে রাস্তায় নেমেছি। ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে রাস্তার সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোতে হাঁটবার ইচ্ছেটা আমার বহু পুরনো। মানুষজন আমাদের দিকে(বিশেষ করে আমার দিকে) অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কারন বউয়ের সাজে সাধারণত কেউ ফুটপাত দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে না! এই দৃশ্য ঢাকার রাস্তায় বিরল। না জানি বাসার অবস্থা এখন কি! আম্মু-আব্বুর জন্য অনেক খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি তো একটা সমঝোতা করে আমার জীবনটা তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারি না! যে ভালবাসার স্বপ্ন বুনেছি সারাটি জীবন ধরে, সেই ভালবাসাকে এতো কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলবার সাহস আমার নেই। আর আমি অঝরকে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি। আমি জানি, ও কোনদিন আমার এই হাতটা ছেড়ে দিবে না। ওর চোখের মাঝে আমি আমার ছায়া দেখেছি, আমি ওকে আমার জন্য কাঁদতে দেখেছি। আমি কিভাবে এই ভালবাসাকে দুপায়ে মাড়িয়ে অন্য কারো সাথে নিজের জীবনটা জুড়তে পারি! নাহ, এসব চিন্তা করাও পাপ!

এতো কি ভাবছো?”
আমাকে তো বাসা থেকে ভাগিয়ে নিয়ে এলে। এখন তুমি কি করবে সেটাই ভাবছি।
এর মধ্যে এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। এখন আমি তোমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসে যাবো এবং আগামী প্রত্যেক বছর এইদিনে আমরা আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করবো। বুঝেছো?”

আমি অঝরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কখন যে আমার চোখের কোণ ভিজে উঠেছে, বুঝতেই পারিনি! মানুষ এতো পাগল হয় কিভাবে!

সেরাতেই আমরা বিয়ে করে ফেললাম। ধানমণ্ডি কাজী অফিসে সাক্ষী হিসেবে অঝরের কয়েকজন বন্ধু উপস্থিত ছিল। আগে কখনো দেখিনি ওদের। তবে একজনের নাম প্রায়ই শুনতাম ওর মুখে, “হিমেল।ছেলেটা বেশ চটপটে আর প্রচুর কথা বলে। আমার কথা আগে কখনো জানায় নি বলে অঝরকে কি ঝাড়িটাই না দিল!

আমি এখন অঝরের বউ। এ কথা ভাবতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। মানুষের জীবনের স্বপ্নগুলো যে এভাবে সত্যি হতে পারে, আমি জানতাম না। সবসময় মনে হতো এই পৃথিবীতে আমি অনাকাঙ্ক্ষিত। অঝর আমার সেই ভুল ভেঙ্গে দিল। আজ আমি সত্যিই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ।

কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। গন্তব্য হল, আমার শ্বশুরবাড়ি। অজানা আশঙ্কায় বারবার কেঁপে উঠছিলাম। যেখানে অঝরের আম্মু আমাকে একদমই পছন্দ করেন না, সেখানে এখন আমি তার ছেলের বউ! এই ব্যাপারটা তিনি কখনোই সহজভাবে মেনে নিতে পারবেন কি! তবে আমি এটুকু জানি যে, আমার এখন কোন ভয় নেই। কারন অঝর আমার সাথে, আমার পাশে রয়েছে।

গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে হঠাৎ করেই অঝর আমার হাতটা ধরল, আর বলল, “বউ, তোমাকে অনেক ভালবাসি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর এই কথাটি শুনে বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠলো! একেই হয়তো বলে, “ বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা......

আমার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিলো অঝরের হাত। আমাকে কাঁদতে দেখে ও বলল
,
আজকে আর কতবার কাঁদবা? গাড়ির টিস্যু বক্সে কিন্তু বেশি টিস্যু নাই।

ও হাসতে থাকল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইশ
, মানুষটার হাসি এতো সুন্দর কেন? আমি বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারি নি। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বললাম,

ঢং না করে, গাড়িটা স্টার্ট দাও।
পাগলী।এই বলে হাসতে হাসতে ও গাড়ি স্টার্ট দিল। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ভেজা চোখে রাস্তার হলুদ সোডিয়াম বাতিগুলো দেখতে আজ খুব ভালো লাগছে।

অঝরের আম্মু আমাকে এই বেশে দেখে চমকে উঠলেন। তিনি একবার আমার দিকে আরেকবার অঝরের দিকে পালা করে করে তাকাতে থাকলেন। তারপর অঝরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললেন, “এই মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।

আমি জানতাম এমন কিছুই হবে। নিজের জন্য খারাপ লাগছে না, খারাপ লাগছে অঝরের জন্য। আমার কারণেই তো এসব কিছু হল। অঝর হয়তো আমার মনের কথাগুলো বুঝতে পারছিল। তাই তো আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল আর অর আম্মুর চোখের সামনে দিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে।

বাইরে বেরোতেই অঝরের আব্বুর সামনে পড়লাম। কি যেন একটা কাজে এতক্ষন বাইরে ছিলেন তিনি। আমাদের একসাথে দেখে তিনিও খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন। গত কয়েক ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া সব কিছুই অঝর বলল তাকে। তিনি চুপ করে সব কিছু শুনলেন, তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

তোমার আম্মুর ব্যবহারে কিছু মনে করো না মা। আসলে অঝরের বিয়ে নিয়ে ওর অনেক রকম চিন্তা ভাবনা ছিল তো, তাই...
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, “আমি কিছুই মনে করিনি, আব্বু।

আমার মুখে আব্বু ডাক শুনে অঝর মুচকি হাসল। ওর সেই হাসি দেখে আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম!

এর মাঝেই আব্বু অঝরকে বললেন, “আপাতত শ্রাবণকে নিয়ে আমাদের বাংলো বাড়িটায় ওঠ। তোর আম্মুর কথা ভাবিস না, আমি তোর আম্মুকে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবো।

আব্বুর সম্মতিতেই অঝর আমাকে নিয়ে রওয়ানা হল ওদের বাংলো বাড়িতে। সেই বাংলো বাড়ি, যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের কদমফুলের স্মৃতি।
আগেরবার দিনের আলোয় জায়গাটা দেখেছিলাম, আর আজ চাঁদের আলো সেই জায়গাটার চেহারাই পাল্টে দিয়েছে। আকাশে মস্ত বড় একটা চাঁদ, ঝি ঝি পোকার ডাকাডাকি, আলো জ্বালিয়ে দু-একটা জোনাকি পোকার উড়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ।

আমি অঝরের হাত ধরে দরজা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম, ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম সবকিছু। মতিন মিঞ্চা নামের সেই পিচ্চিটাও আমার পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো। অঝরের ডাকে পেছনে ফিরে তাকালাম।

এভাবে কি দেখছ শ্রাবণ? আগেও তো একবার এখানে এসেছিলে, কদম ফুল নিতে। মনে নেই?”
থাকবে না কেন? অবশ্যই মনে আছে।
তাহলে আজ এতো অবাক হয়ে কি দেখছ?”
সেদিন এটা শুধুমাত্র তোমাদের বাংলো বাড়ি ছিল। আর আজ থেকে এখানে আমাদের সংসার জীবনের শুরু হচ্ছে। তাই সবকিছু একটু বেশি ভালো লাগছে। তুমি এসব বুঝবা না।”-বলেই আবার আমার পর্যবেক্ষণ কাজে মনোযোগ দিলাম।

ঠিকমতো সবকিছু দেখব, এর আগেই অঝর আমার হাত ধরে বলল, “চল, তোমাকে আরও সুন্দর একটা জিনিস দেখাই।

ও আমাকে বাইরে নিয়ে এলো। সেখানে বড় একটা দোলনা বাতাসে একটু একটু করে দুলছে। দোলনার প্রতি সেই ছোটবেলা থেকেই আমার কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে। আমি বাচ্চাদের মতো ছুটে গিয়ে দোলনায় বসলাম।
আমি অঝরের কাঁধে মাথা রেখে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি আর অঝর আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। হঠাৎ করেই অঝরের দিকে তাকিয়ে বললাম,

এই শোনো, আমার একটা আবদার রাখবা?”
কি আবদার?”
আগে বলো, রাখবা...
তোমার কোন আবদার আমি না রেখে পারি?”
আচ্ছা তাহলে শোনো। তোমাকে আমাদের জন্য একটা ট্রি হাউজ বানাতে হবে।
ট্রি হাউজ!!
হ্যাঁ, ট্রি হাউজ। জোছনা রাতে আমি তোমার সাথে সেই ট্রি হাউজে বসে জোছনা গিলবো।
আচ্ছা পাগল মেয়ে তো তুমি!
বানিয়ে দিবা তো?”
বউয়ের কথা কি অমান্য করা যায়??”
আমি হেসে ফেললাম। অঝর নিশ্চুপ হয়ে দেখেছে আমার সেই হাসি। মনে হল, ও আমার হাতটা আরও শক্ত করে ধরেছে। নিজেকে আজ বিলীন করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর মাঝে। এতো সুখ, এতো ভালবাসা আমার কপালে সইবে তো?? আমি আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদটা যেন আমার দিকে তাকিয়ে নীরব ভাষায় বলছে, ভালবাসার ওই হাতটা কখনো ছেড়ে দিও না।
আমি অঝরের দিকে তাকালাম...আর ওর কানের কাছে মৃদু কণ্ঠে বললাম, “তোমাকে ভীষণ ভালবাসি।
অঝরের মুখে এক প্রশান্তির ছায়া দেখতে পেলাম। নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছে আজ......খুব বেশি সুখী...... 























ojhor srabon dhara.jpg        “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (২য় পর্ব)
                                  ||শ্রাবণের কথা||

মাদের বিয়ের প্রায় একমাস হতে চলেছে। আমার সংসার আমি নিজ হাতে গুছিয়ে নিয়েছি। সকালে উঠেই আমার প্রথম কাজ হল ওর জন্য চা বানিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সাহেবের ঘুম কি আর সহজে ভাঙ্গে?? তবে আমার কাছে ঘুম ভাঙ্গানোর মহা ঔষধ আছে। আধা বালতি পানি, আর কিছু লাগে না। পানির ছোঁয়ায় এক লাফে বিছানা ছাড়েন তিনি। তারপর আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন এখনই আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। ঐ চাহনির বিনিময়ে আমি মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দেই, ব্যাস। সবকিছু আন্ডার-কন্ট্রোল।

অঝর আমার এমন সব পাগলামির সাথে পরিচিত ছিল না। জানি না, ও কি ভাবছে আমার সম্পর্কে। তবে আমি এটুকু জানি, ও আমার জীবনে আসার পর থেকে আমার পাগলামিগুলো আরও বেড়ে গিয়েছে।

সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঝমঝম একটা আওয়াজ শুনছিলাম। বুঝতে পারলাম, বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি। বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রাখা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেখলাম, রাত ৩ টা বাজে। বৃষ্টিতে ভিজবার জন্য এটা আমার কাছে খুব বেশি রাত না। কত রাতে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি! অবশ্য তখন একা ছিলাম, আজ তো দোকাহয়ে গিয়েছি!
আমার পাশে অঝর আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ইশ, কি প্রশান্তি ওর ঘুমন্ত মুখটায়। ওর ঘুমটা কি ভাঙ্গাবো? কি করবো! বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলে আমি এখন পাগল হয়ে যাবো! কিছুক্ষণ ভেবে ওর ঘুম ভাঙ্গানোর সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম।

-
এই শুনছো? এই, ওঠো তো একটু।
-
কি হল! মাঝরাতে আমাকে ঠেলছো কেন?- ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল অঝর।
-
এই শোনো না। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি।
-
শ্রাবণ, প্লিজ এখন এটা বলো না যে তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে!
-
বাহ, তুমি তো আমার মনের কথাগুলো খুব ভালো মতো বুঝতে পারো!
-
শ্রাবণ!! এই মাঝরাতে পাগলামি করবা না তো! চুপ করে ঘুমাও...।
-
তুমি আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে যাবা না?
-
রাত দুপুরে পাগলামি করার কোন মানে হয় না।
-
হ্যাঁ, এখন তো ভালো লাগবেই না। বিয়ের আগেই সবকিছু ভালো লাগে। তোমাকে ভিজতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।

এই বলে বিছানা থেকে ছেড়ে উঠলাম আমি। কুম্ভকর্ণটা ঘুমাতে থাকুক। আমি একাই বৃষ্টি বিলাস করবো। দরজাটা খুলে বাইরে বের হওয়ার সময় আরেকবার ওকে দেখার জন্য পেছনে তাকালাম! চমকে গেলাম, কারন ও আমার পেছনেই দাঁড়িয়েছিল! পা টিপেটিপে কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি!
-
তুমি উঠলা কেন??
-
বৃষ্টিতে তোমার পাগলামি দেখতে ইচ্ছা করছে।
-
ঢং করো না।
আমার মুখে তখন বিশ্বজয়ী হাসি। বিশ্বজয় করলেও এতো বেশি খুশি হতাম না।

অঝরের হাত ধরে আমি বৃষ্টিতে ভিজচ্ছি। ভেজা ঘাসগুলো আমার খালি পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর ভেজা ঘাসের উপর বসে পড়লাম আমি। আর অঝরটা যে কি পাগল! আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আর বলল,

-
শ্রাবণ, একটা গান শোনাও না।

আমি গান শুরু করলাম...
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ
পড় দেহ ঘেরি মেঘ নীল বেশ
কাজল নয়নে জুথি মালা গলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে…….”

অঝর এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-
কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছ?
-
একটা কথা চিন্তা করছিলাম।
-
কি কথা?
-
সেদিন যদি তোমাকে ভাগিয়ে না নিয়ে আসতাম তাহলে আমার কপালে এতো সুখ জুটতো না। তোমাকে অসম্ভব রকম ভালোবাসি...
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কারন আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে...

এই পাগলটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তা না হলে কি ছিল আমার জীবন! সেই ঘরের কোনে পরে থাকা, নিজের সাথে কথা বলা, মানুষের নানা রকম কথা শোনা, আব্বু-আম্মুকে অপমানিত হতে দেখা... এর বাইরে আর কিছু কি কখনো ঘটেছে আমার সাথে? অঝরের সাথে আমার জীবনটা নতুন করে শুরু করার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল না। হ্যাঁ, আব্বু-আম্মুকে একটু কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, কিন্তু ঐদিন যদি এই কাজটা না করতাম, তাহলে হয়তো কোনদিন সুখী হতে পারতাম না। জীবনটা নিয়ে সমঝোতাই করে যেতে হতো সবসময়।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দিনগুলো স্বপ্নের মতো কেটে যাচ্ছে। অঝরের ভাষ্যমতে, “আমি এখন পাকা গৃহিণী।অঝর অফিসে চলে গেলেই শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে কাজ করা শুরু করে দেই। আর আমার সহকারি হিসেবে মতিন মিঞ্চা তো আছেই! পিচ্চিটাকে মাঝে মাঝে পড়াতে চেষ্টা করি। কিন্তু ওর মাথায় কিছুই ঢুকতে চায় না। আজ শেখালে পরেরদিনই ভুলে যায়। তবে আমার উৎসাহের কমতি নেই। অঝর আমার কর্মকাণ্ড দেখে হাসে। অবশ্য গত ছয় মাস ধরে প্রতিদিন আমার পাগলামি দেখাটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আজ বিকালে ওর এক বন্ধু, তারেকের বাসায় ছোট একটা গেট টু গেদার পার্টি আছে, সেখানেই যাবো আমরা। শুনেছি, তারেক রিসেন্টলি বিয়ে করেছে। কাজের চাপে অঝর বিয়েটা মিস করেছে। এজন্য নাকি তারেকের কাছে বেশকিছু কথাও শুনতে হয়েছে ওকে। তাই আজকের এই প্রোগ্রাম মিস করার কোন ইচ্ছে ওর নেই। আর সব বন্ধুরা একসাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলে মন্দ হবে না ব্যাপারটা। এই সুযোগে আমিও সবার সাথে পরিচিত হতে পারবো।

হাতের কাজগুলো তাই ঝটপট সেরে ফেলতে চাইছিলাম। মতিনকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর বাবা বেশ কিছুদিন ধরেই খুব অসুস্থ, আজ নাকি শরীর একটু বেশিি খারাপ করেছে। বাসায় এখন শুধু আমি আর অঝর। অনেকক্ষণ ধরেই অঝর আমার পিছু পিছু ঘুরছে। ওর মতলব আমি ঠিকই টের পেয়েছি। দু-তিনবার পেছনে ফিরে চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়েছি। তবুও পিছু ছাড়ছে না। তাই রাগের অভিনয় করে বললাম,

-
আমার পিছে ঘুরঘুর করো না তো! কাজ করতে দাও।

বেচারা আমার কথা শুনে একটা বই হাতে সোফায় বসে পড়লো। ওর হাতে এই বইটা প্রায়ই দেখি, হুমায়ূন আহমেদের তেঁতুল বনে জোছনা।বইটা নাকি ওর ভীষণ প্রিয়। প্রথমবার এই বই পড়ে সাইকেল ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিলো জনাবের। আমি শুনে খুব হেসেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম,
-
ভালোই হতো, তুমি হতে সাইকেল ডাক্তার। আর আমি সাইকেল ডাক্তারের বউ। তোমার সাইকেল চড়ে গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে ঘুরে বেড়াতাম।
পাগলটা মুখ গোমড়া করে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছে। ইশ, এভাবে না বললেও পারতাম! আমি আমার হাতের কাজ ফেলে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বইয়ের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে একটু তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিল।
আমি ওর পাশে বসে পড়লাম আর বললাম,

-
সাইকেল ডাক্তার, এতো রাগ করতে হয় না। ব্লাড প্রেসার হাই হয়ে যাবে।
আমার কথা শুনেও কিছু বলল না। বুঝলাম, ভালোই রাগ করেছে। আমি তখন ওর হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলাম।
ও রেগে জিজ্ঞেস করলো ,
-
এটা কি হল??
আমি তখন বললাম,

-
অঝর বাবু, অঝর বাবু
রেগে হল অল্পতেই কাবু
রাগের চোটে নাকের ডগা হয়ে গেল লাল
ইচ্ছে হচ্ছে আদর করে টেনে দেই গাল...

এই বলেই আমি ওর গাল দুটো টেনে দিলাম। পাগলটা আর রাগ করে থাকতে পারল না। ফিক করে হেসে ফেললো। ওর এই হাসিটা আমার খুব ভালো লাগে। আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল,
আমাকে এখন আর আগের মত ভাল লাগে না, তাই না শ্রাবণ?
-
এই সব কি বলছো পাগল?
-
ঠিকই তো বললাম। সবসময় নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকো। আমার সাথে একটু সময় কাটানো যায় না?
-
আচ্ছা পাগল, এই কান ধরলাম। এই রকম ভুল আর কখনো হবে না। এই বারের মত মাফ করে দাও।

পাগলটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মনে হল যেন রাজ্যের সুখ এসে ধরা দিয়েছে আমার দুহাতে। আমিও ওকে আঁকড়ে ধরলাম, কোনদিন ছাড়বো না, কখনো না... 

















ojhor srabon dhara.jpg            “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (২য় পর্ব)
                                     ||অঝরের কথা---||
সারাদিনের ক্লান্তি এখন আর ক্লান্তি মনে হয় না। সব কিছু কেমন যেন পরিপাটি হয়ে গিয়েছে। অফিস হতে বাসায় ফিরতেই শ্রাবণের হাসিমাখা মুখ দেখে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

বিয়ের প্রায় এক মাস হতে চলেছে, এখনো শ্রাবণের গা হতে বিয়ের দিনের সুবাস পাওয়া যায়। আমাকে পাগল করে দেওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। এই দীর্ঘ এক মাসে শ্রাবণকে অনেক কাছ থেকে বুঝতে শিখেছে। ওর ভাললাগা মন্দলাগা সব। কোন মানুষকে তখনই সবচেয়ে ভাল বোঝা যায়, যখন তার সান্নিধ্যে আসা হয়।

এখন শ্রাবণ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। এককথায় আমি শ্রাবণের পাগলামি দেখে পুরোই হতবুদ্ধি, যাকে আরো ভালভাবে হিতাহিতজ্ঞান শুন্য বলা যেতে পারে।

শ্রাবণের সাথে পরিচয় না হলে আমি হয়তো কখনো টেরও পেতাম না যে, একজন মানুষ কতটা যত্নশীল হতে পারে। ঘুম থেকে উঠার আগেই চা এসে হাজির। তবে সবসময় যে ঘুম থেকে উঠার স্মৃতি সুখকর হয়, তা কিন্তু নয়। দুইবার ওয়ার্নিং দেবার পরও যদি ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়, তাহলে সেদিনের গোসলটা বিছানাতে ঘুমের মধ্যেই করতে হয়। এক বালতি পানি, শেষ বিন্দু পর্যন্ত পুরোটা আমাকে ঐ অবস্থায় নিজের করে নিতে হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় শ্রাবণকে ধরে! না থাক, সেই ইচ্ছার কথা না হয় পরেই জানবেন।

অফিসে যাবার সময় হলেই যাবতীয় সব দরকারি জিনিস এসে হাজির। আবার অফিস থেকে ফেরার পর এলোমেলো করে ফেলে দেওয়া সব কিছু গুছানোর কাজটাও আমার বিবি মহাশয়াই করে থাকেন। অনেকটা বউ এর উপর দিয়েই চলে যাচ্ছে দিনগুলো। পাগলীটাকে নিয়ে সত্যিই খুব সুখে আছি। বিধাতার কাছে একটা আবদার আমার, কখনো যেন কোন কারনেও যেন এই পাগলীটা আমার কাছ থেকে হারিয়ে না যায়, তাহলে সত্যি মরে যাবো।

শ্রাবণের পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ওকে নিয়ে আর পারা যায় না। মাঝরাতে হঠাৎ ডাকা শুরু।

-
এই শুনছো? এই, ওঠো তো একটু।
-
কি হল! মাঝরাতে আমাকে ঠেলছো কেন? খুবই বিরক্ত হয়ে বললাম।
-
এই শোনো না। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি।

আমি তাকালাম জানালা দিয়ে। হ্যাঁ, বাইরে সত্যি ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে আর সাথে বাজ পরার প্রচন্ড শব্দ। ঘুমের ঘোরে থাকায় এতক্ষণ শব্দগুলো কানে আসে নি। মানুষের মস্তিষ্কের ব্যাপারগুলো কিছুটা অদ্ভুত। যখন যেটা দরকার, সে ঐটাই গ্রহণ করে থাকে, বাকিটা প্রত্যাখ্যান করে। এতক্ষণ যাবত বৃষ্টির শব্দ মোটেও কানে আসছিল না, শ্রাবণ বলা মাত্রই মস্তিস্ক বৃষ্টির দিকে মনোনিবেশ করলো আর আমি অদ্ভুত সুন্দর এই বৃষ্টির ঘ্রাণ অনুভব করলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু কাল অফিস আছে, তাছাড়া এই মাঝরাতের বৃষ্টিতে ভিজলে যদি শ্রাবণের জ্বর চলে আসে তো? অদম্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সংযত করে নিলাম আর শ্রাবণের উদ্দেশ্যে কিছু কথা ছুঁড়ে দিলাম-

-
শ্রাবণ, প্লিজ এখন এটা বলো না যে তোমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে!
-
বাহ, তুমি তো আমার মনের কথাগুলো খুব ভালো মতো বুঝতে পারো!
-
শ্রাবণ!! এই মাঝরাতে পাগলামি করবা না তো! চুপ করে ঘুমাও...।
-
তুমি আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে যাবা না?
-
রাত দুপুরে পাগলামি করার কোন মানে হয় না
-
হ্যাঁ, এখন তো ভালো লাগবেই না। বিয়ের আগেই সবকিছু ভালো লাগে। তোমাকে ভিজতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।

শ্রাবণ একা একা বৃষ্টিতে ভিজতে যাচ্ছে, আর আমি ঘুমুবো!!! এই কি হয়। চুপচাপ পাগলীটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজাটা খুলল শ্রাবণ, এক ঝাপ্টা বাতাস এসে খনিক মুহূর্তের জন্য ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমায়। আতকে উঠলাম শ্রাবণের কন্ঠ শুনে-

-
তুমি উঠলা কেন??
-
বৃষ্টিতে তোমার পাগলামি দেখতে ইচ্ছা করছে।
-
ঢং করো না।

আমার পাগলীটা হাসছে, ওর এই ভুবনভুলানো হাসি দেখে কাটখোট্টা লোকের মুখেও হাসি চলে আসবে। পাগলীটাকে ভীষণ ভালবাসি.........।।

শ্রাবণের হাতে হাত রেখে বৃষ্টিতে ভিজছি। শ্রাবণের গা বেয়ে বেয়ে পরা বৃষ্টির প্রতিটি ফোটার সাথে আড়ি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। ওদের সাহস দেখে আমি বরাবরের মত অবাক হচ্ছি, আমার বউ এর গায়ে চড়ে বসেছে। অনেক বাড় বেড়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোটা গুলো। তাই শ্রাবণকে টেনে নিয়ে ভেজা ঘাসের উপর বসিয়ে দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম, যাতে করে ওর গায়ে বৃষ্টির ফোটা কম কম পড়ে। এই অবস্থায় খুব গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাই পাগলীটাকে একটা গান শোনাতে বললাম। পাগলীটা কোন রকম ইতস্তত না করে গান শুরু করলো-

এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে
দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ
পড় দেহ ঘেরি মেঘ নীল বেশ
.
.
.
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে

অভূতপূর্ব মুগ্ধতা আমাকে গ্রাস করেছে। অপলক তাকিয়ে আছি আমার বউটার দিকে। নিজেকে এক স্বর্গীয় অনুভূতির মধ্যে আবিষ্কার করলাম শ্রাবণের কন্ঠ শুনে,

-
কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছ?
-
একটা কথা চিন্তা করছিলাম।
-
কি কথা?
-
সেদিন যদি তোমাকে ভাগিয়ে না নিয়ে আসতাম তাহলে আমার কপালে এতো সুখ জুটতো না। তোমাকে অসম্ভব রকম ভালোবাসি...
পাগলীটার চোখ কেমন যেন চকচকিয়ে উঠলো। মনের মধ্যে কেমন যেন এক ব্যাথা অনুভব করতে লাগলাম, একেই হয়তো বলে সুখের মতো ব্যাথা।

অফিসে যাবো না ঠিক করেছি, আজ সারাটা দিন শ্রাবণের। তারেকের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে, অফিসের ঝামেলার কারনে ওর বিয়েতে যাওয়া হয়ে উঠে নি। অনেক রাগ ঝেরেছে সেদিন ফোন করে। আজ একবার শ্রাবণকে নিয়ে ওর ওখান থেকে ঘুরে আসবো ভাবছি। একটা গেট টু গেদার পার্টিও আছে। শ্রাবণকে বলতেই রাজি হয়ে গেল। বিকেলে যাবো।

সকাল থেকেই শ্রাবণের পেছন পেছন ঘুরছি। কিন্তু শ্রাবণ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। নিজের কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত। ইচ্ছে হচ্ছে ওকে ধরে একটা, না থাক ইচ্ছের কথাটা বাদ দিলাম। খুব মন খারাপ করে একটা বই হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ এর তেতুল বনে জোছনা।বইটা এই নিয়ে কম হলেও শ বারের বেশি পড়ে ফেলেছি। প্রথমবার যখন বইটি পড়ি খুব ইচ্ছে হয়েছিল সাইকেল ডাক্তার হবার। কিন্তু পোড়া কপাল আমার। পড়ালেখায় এতটা ভাল ছিলাম না।

তারেক আর রুপন্তির প্রেম কাহিনী আমাদের বন্ধু মহলে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। একজন বিবিএ পড়া ছাত্র কি করে একটা ডাক্তার মেয়েকে পটালো, এই নিয়ে তারেককে বন্ধুদের কাছ থেকে কম কথা শুনতে হয় নি। তারেকের বাসা ঢাকাতেই এবং আমাদের সবারই কম বেশি ওদের বাসায় যাওয়া আসা ছিল, তাই আঙ্কেল আন্টির সাথে অনেকটা সুসম্পর্কের মত গড়ে উঠেছিল সবার। যেহেতু তারেকের রিলেশন সম্পর্কে আমাদের বন্ধুমহল খুব ভাল ভাবেই অবগত ছিল, তাই তারেকের ভয় হত, যদি আমাদের কেউ এই কথা আঙ্কেল আন্টির কানে দিয়ে দিতে পারি তো তারেকের কেল্লা-ফতে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কতবার যে ওর কাছ থেকে ট্রিট নিয়েছে এর হিসেব নেই। বেচারা সত্যি বুঝত না যে, সত্যিকারের বন্ধুরা কখনো কোন কারনেও নিজের বন্ধুদের বিপদে ফেলে না, যদিও সে বিপদে পড়ুক।

হঠাৎ আমার পাশে অন্য আরেকজনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। আর এই অন্য একজন যে, আমার পাগলীটা ছাড়া অন্য কেউ নয়, সেটা বুঝতে আমার বেশি বেগ পেতে হল না। আমি গোমড়া মুখ করে চুপটি মেরে আছি। পাগলীটা এসে আমার পাশে বসলো। আর ফিসফিস করে বলল-

-
সাইকেল ডাক্তার, এতো রাগ করতে হয় না। ব্লাড প্রেসার হাই হয়ে যাবে।

আমি ওর মুখে সাইকেল ডাক্তার এর কথা শুনে অবাক হলাম। আমি কি ওকে এর মধ্যে সাইকেল ডাক্তার সম্পর্কে কিছু বলেছি? নাকি ও এই বইটা আগেই পড়েছে? যদি পড়েও থাকে, তাহলে আমাকে কেনই বা এই নামে ডাকবে? কিছুতেই কিছু মিলছে না। ইদানীং মস্তিস্ক পুরাতন স্মৃতিগুলো খুব সহজেই ভুলে যাচ্ছে। আমি চুপ করেই রইলাম। শ্রাবণ আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে দিলো।
অনেকটা রাগ হবার ভঙ্গীতেই জিজ্ঞেস করলাম,

-
এটা কি হল??

কিন্তু উত্তরে যা শুনলাম, তা শুনে আর যেই হোক, কোন স্বাভাবিক মানুষ রাগ করে থাকতে পারে না।

-
অঝর বাবু, অঝর বাবু
রেগে হল অল্পতেই কাবু
রাগের চোটে নাকের ডগা হয়ে গেল লাল
ইচ্ছে হচ্ছে আদর করে টেনে দেই গাল...

এই বলেই ও আমার গাল দুটো টেনে দিতে লাগলো। হায়রে পাগলী।
আমি ওর হাত দুটি কোলের উপর রেখে অভিমানী ভাবের রেশ রেখে বললাম-

-
আমাকে এখন আর আগের মত ভাল লাগে না, তাই না শ্রাবণ?
-
এই সব কি বলছো পাগল?
-
ঠিকই তো বললাম। সবসময় নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকো। আমার সাথে একটু সময় কাটানো যায় না?
-
আচ্ছা পাগল, এই কান ধরলাম। এই রকম ভুল আর কখনো হবে না। এই বারের মত মাফ করে দাও।

আমি হাসি মুখে ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম, যেন কোন শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না......





ojhor srabon dhara.jpg           “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (৩য় পর্ব)
                                     ||অঝরের কথা---||

ব বন্ধুরা এসে উপস্থিত। আড্ডার আসর জমেছে। আড্ডার মধ্যমণি এখন আমি। বন্ধুদের মধ্যে আমাদের বিয়ে সম্পর্কে জানার কৌতূহলটা অনেক বেশি। হঠাৎ করে না জানিয়ে বিয়ে করায় বোধহয় কৌতূহলটা একটু বেশিই কাজ করছে ওদের মাঝেবন্ধুরা মিলে আড্ডায় মশগুল আর অন্য দিকে শ্রাবণ রুপন্তির সাথে বসার ঘর ছেড়ে ওদের ধরে বসে আলাপচারিতা করছে। রুপন্তি হচ্ছে তারেকের বউ। শ্রাবণকে ডেকে নিয়ে যেতে এসেছিল, তখন এক নজর দেখা। বেশ সুন্দর আর ভদ্র মনে হল মেয়েটাকে। ওদের সাথে আমাদের ক্লাসমেট শায়নাও আছে। আমাদের বিয়ের দিনও কি এক কাজে যেন খুব ব্যস্ত ছিল, তাই আর কাজী অফিসে আসে নি। এরপর থেকে যে কতবার আমাকে ফোন দিয়েছে শুধুমাত্র এক নজর শ্রাবণকে দেখবার জন্য। ওর ভাষ্যমতে-

অঝর, তোর বউটা অনেক ভাগ্যবতী, কেননা ও তোর মত ছেলে পেয়েছে। ও নিশ্চয় দেখতে অনেক সুন্দরী আর অনেক ভাল। তাই নারে?”

উত্তরে আমি বলছিলাম-ও আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। ওর ভুবনভোলানো হাসি দেখে যে কেউ একনিমিষেই ওর প্রেমে পড়ে যাবে। আর কথা যখন আসে ভাল-মন্দের। সেক্ষেত্রে আমি হলফ করে বলতে পারি যে, ওর মত ভাল মেয়ে খুঁজে পাওয়া সত্যি মুশকিল।

এরপর থেকে ও নাছোড়বান্দার মত পিছে লেগেছিল শ্রাবণকে দেখার জন্য। আজ সেই সুযোগ পেয়ে আর হাতছাড়া করে নি ও, আমাদের কাছের বন্ধুদের মধ্যে ও একজন। কেন যেন আমার মাঝে মাঝেই মনে হত ও আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু কখন মুখ ফুটে বলতে পারতো না।

হঠাৎ শ্রাবণকে অনেকটা তড়িঘড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে দেখলাম। এসে হুট করে সামনে দাঁড়িয়ে বললো-

অঝর, একটু শুনবে?”
আমি কিছুতা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- কি হয়েছে শ্রাবণ?”
আমার ঠিক ভালো লাগছে না। বাসায় যাবো।
স্রাবনে মুখে এই কথাগুলো শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কি হয়েছে আমার পাগলীটার। ওকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছুই কাউকে বুজতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- এখনি যেতে হবে??”
হুম।

আমার পাগলীটার মুখে হুম কথাটি শুনে সাথে সাথে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না। আমি ঠিক বুঝতে পারছি শ্রাবণের কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় আমি কিছুই জিজ্ঞেস করা যাবে না। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। তারেক আর ভাবী অবশ্য কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। পরে তারেককে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বলব ব্যাপারটা, ও ঠিক বুঝবে। তাই আর কোন চিন্তা না করে আমার পাগলীটার দিকে মনোনিবেশ করলাম। আমার পাগলীটা যে আমার কাছে সব। ওর জন্য খুব খারাপ লাগছে, এমন কি হল, যার জন্য এত হুট-হাট করে চলে যেতে চাচ্ছে ও। নিশ্চয় বেশ বড় রকমের কিছু। আমি ওকে এখন এটা কি করে জিজ্ঞেস করবো!! কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার জন্যই তো এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিজেকে খুব করে বকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ড্রাইভ করে চলেছি। পাশের সিটে শ্রাবণ চুপচাপ বসে আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। আজকের আকাশটা অনেক বেশি সুন্দর। মেঘ জমেছে চারপাশে। এ যেন আকাশ পানে মেঘের জাল ফেলবার মত ব্যাপার। আমাদের বাঙ্গলো বাড়িটা কিছুটা গ্রাম সাইডে হওয়াতে প্রকৃতির সৌন্দর্যের বেশীর ভাগটাই অবলোকন করার সুযোগ হয়ে থাকে। শ্রাবণ নিশ্চয় বাইরের ঐ কাশবনের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর কাশবন খুব প্রিয়। আমার খুব খারাপ লাগছে ওর জন্য, কিছুই করতে পারছি না এখন। খুব ইচ্ছে করছে গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে ওকে নিয়ে বের হই। দিগন্ত জোড়া কাশবনের উপর দিয়ে শ্রাবণের হাতে হাত রেখে হেঁটে আসি দুজন। পড়ন্ত সূর্য, খালি পায়ে কাশবনের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো দুই মানব-মানবী। একজনের পড়নে সাদা পাঞ্জাবি আর অন্যজনের পড়নে লাল পেড়ের সাদা শাড়ি। কিন্তু সাহস হচ্ছে না শ্রাবণকে বলতে এই কথাগুলো। আমি আপনমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ কেন যেন মনে হল- আমার বউটা কাঁদছে। আমি তাকালাম ওর দিকে, ওর চোখ থেকে তখন লাল আভা বের হচ্ছিলো। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমার বউটা কাঁদছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওকে শক্ত করে একটিবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এখন তা সম্ভব না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম-

কি হয়েছে তোমার শ্রাবণ? তারেকের বাসা থেকে চলে আসতে চাইলে, বের হওয়ার পর একটা কথাও বলো নি! কি হয়েছে বলবে?”
কিছু না।
আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছো?”
তুমি প্লিজ ঠিকমতো ড্রাইভ করো।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওকে এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে দেওয়াই শ্রেয়। মাঝে মাঝে নিজের কষ্টগুলোকে নিজেকেই শান্ত করতে হয়। তা না হলে সেই কষ্টগুলো জমে জমে অনেক বড় আকার ধারন করতে পারে।

চলে এসেছি বাসায়। গাড়ি থেকে নামতেই মতিন মিঞ্চার চিৎকার শুনতে পেলাম। কিছুটা দূরেই মতিনকে দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে দৌড়ে আসলো আর আমায় জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করল-

-
কি হয়েছে রে?
-
আব্বা মইরা গেসে গো ভাবী।

কথাটা শোনার সাথে সাথেই যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সেদিনও চাচার সাথে কথা হয়েছিল আমাদের দুজনের। আমাদেরকে আশীর্বাদ করে দিয়েছিল। তখন তো বেশ সুস্থই ছিলেন তিনি। হঠাৎ করে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝলাম না। চাচা অনেক ভাল লোক ছিলেন। আমি ছোট বেলা হতেই আমাদের এখানে চাচাকে বাড়ি দেখাশোনার কাজে দেখে আসছি। বাবার অনেক বিশ্বস্ত আর কাছের লোক ছিলেন উনি। বাবা নিশ্চয় উনার মৃত্যুর সংবাদে অনেক কষ্ট পাবে।

শ্রাবণ হাঁটু গেড়ে বসে মতিনকে জড়িয়ে ধরলো, আমিও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো- দুপুর থেকেই আব্বায় কাশি দিতে দিতে কাহিল হয়ে পরছিল। বাইনা বেলা অবস্থা আরো খারাপ হইতে লাগলো, শুরু হইলো রক্ত বমি। আর এরপর......বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলো মতিন।

শ্রাবণকে রেখেই মতিন মিঞ্চাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রওনা হলাম মতিনদের বাসার উদ্দেশ্যে। গাড়ি হতে নামলাম। দূর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বেশ ভালই বুঝতে পারলাম, ঐটাই মতিনদের বাসা। কিছুটা হাঁটতে হয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। মসজিদ হতে মৃত্যুর সংবাদ কানে ভেসে আসছে। উঠানে লোকের ভিড়। ভিড় ঠেলে লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। লাশ হতে আতরের সুবাস এসে নাকে লাগছে, একটা অন্য রকম অনুভূতিও কাজ করছে। আমি তাকিয়ে রইলাম চাচার মুখের দিকে। কত নিষ্পাপ মুখখানি। সারা শরীর সাদা কাপড়ে মোড়ানো, শুধু মাত্র মাথাটা বের করা। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আছে, মনে হচ্ছে খুবই শান্তির ঘুমাচ্ছে।

বাবাকে ফোন দিলাম। বাবার আসতে একটুও দেরি হল না। বাবার দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ মন খারাপ হল, বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে বাবার কান্না দেখে। আমি নিজেকে শক্ত রেখে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।

চাচার লাশকে গোসল করানো এর পর জানাজার নামাজ এবং কবর দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঐ দিকে শ্রাবণ বাসায় একা, ওর জন্য খুব বেশি রকম চিন্তা হচ্ছে। মতিনকে বাড়িতে রেখে রওনা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। বাবা আরো আগেই চলে গিয়েছে। আমি দ্রুত ড্রাইভ করে এলাম।

ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি পুরো ঘর অন্ধকার। আকস্মিক প্রবল বাতাস এসে ছুঁয়ে গেল। আমার বউটা কোথায়!!! আমি তৎক্ষণাৎ লাইট জ্বালালাম। ঘরের কোণায় সোফায় বসে মাথা নিচু করে আছে আমার বউটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে উঠলো-

-
চলে এসেছ তুমি? কি অবস্থা ওদের?
-
কি আর অবস্থা হবে বলো! কান্নাকাটি করছে সবাই। কিছুদিন পরেই মতিনের বড় বোনটার বিয়ে। মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে। ওর কান্না দেখে আমারই চোখ ভিজে গিয়েছিলো। কেন যে এমন......

কথাগুলো শেষ করতে না করতেই আমার পাগলীটা কান্না-কাটি শুরু করে দিয়েছে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর সব কষ্টগুলোকে নিজের করে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, ওর আব্বু-আম্মুর জন্য খুব খারাপ লাগছে। জিজ্ঞেস করলাম ওকে, আর ও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
-
এভাবে বোকা মেয়ের মতো কাঁদে নাকি! যাও তো, ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো।
-
এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
-
উহু, কোন কথা না। যাও ফ্রেশ হও।

ও লক্ষ্মী মেয়ের মত উঠে দাঁড়ালো। বাথরুমের দিকে যেতেই আমি জামা-কাপড় চেঞ্জ করে নিলাম। অনেকক্ষণ হল বাথরুমে ঢুকেছে, এখনো বের হবার নাম নেই। ওকে নিয়ে আর পারা যায় না

-
শ্রাবণ, এতক্ষণ ধরে কি করছো!

দরজায় টোকা দিতেই মহারাণী এসে হাজির। ওকে অনেকটা খোঁচা দেওয়ার উদ্দেশ্য করে বলা-

-
মেয়েদের নিয়ে এই একটাই সমস্যা, আয়না সামনে পেলে আর সময়জ্ঞান থাকে না!

কথাগুলো শুনেই মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো শ্রাবণ।

-
যাক, এতক্ষণ পর তোমার হাসি দেখলাম। এখন চল আমার সাথে। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

বলেই বের হয়ে পড়লাম, আমি ড্রাইভ করছি আর পাশের সিটে শ্রাবণ বসে আছে। শ্রাবণ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে আজ খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। হঠাৎ মনে হল শ্রাবণ আমাকে কিছু একটা বলেছে-

-
তুমি কি কিছু বললে শ্রাবণ?
-
উহু...

আমি ওকে আর জ্বালাতন না করে নিজের মত করে চাঁদ দেখতে দিলাম, আর আমি মাঝে মাঝে আমার চাঁদটাকে দেখছি। আমার চাঁদটা আমার খুব কাছে, হাত দিয়েই স্পর্শ করতে পারি তাকে......









ojhor srabon dhara.jpg            “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (৩য় পর্ব)
                                      ||শ্রাবণের কথা||

তারেকের বাসাটা ছোট-খাটো, কিন্তু বেশ সাজানো গোছানো। দেখতে বেশ ভালো লাগছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে বাসার দেয়ালে আয়নার কালেকশন দেখে। দেয়ালগুলো জুড়ে নানা রঙের, নানা ডিজাইনের, নানা সাইজের আয়না। এই ব্যাপারটাই কেমন যেন একটু ভিন্নতার ছোঁয়া এনে দিয়েছে ঘরটায়।

অঝর ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মশগুল। মাঝে মাঝে ওদের হাসির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠছে! এভাবে ওকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে ভালোই লাগছে আমার। বিয়ের পর তো এভাবে আর বন্ধুদের সাথে বসা হয়নি ওর।

আমি রুপন্তির সাথে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলছি। রুপন্তি তারেকের বউ। মেয়েটা ভারী মিষ্টি আর বেশ সুন্দরী। ওর অনর্গল কথা বলা দেখে রোদেলার কথা মনে পড়ছে। না জানি বোনটা আমার কি করছে এখন!
রুপন্তি আমাকে ওদের বিয়ের কাহিনী বলছে। ওর কথাগুলো শুনতে আমার বেশ মজা লাগছে।

তুমিই তো শ্রাবণ, তাই না??”

হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে পেছনে তাকালাম। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটাকে দেখছিলাম, কিন্তু তার সম্পর্কে কিছুই জানা হয় নি।

আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই মেয়েটা বলল,

আমি শায়না, অঝরের ফ্রেন্ড।
ওহ! কেমন আছেন?”
হুম, ভালো। তোমাদের কি খবর? নতুন সংসার কেমন চলছে? আন্টি কি তোমাদের বিয়েটা মেনে নিয়েছেন? আসলে সেদিন অঝরদের বাসায় গিয়েছিলাম। আন্টি তো অনেক আপ্সেট। আর আপ্সেট হবেনই না কেন? অঝরকে নিয়ে ওনার কত আশা ছিল, ওর বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল, কোনকিছুই তো হল না! হাজার হোক, একটাই তো ছেলে...

মেয়েটা একটানা এই কথাগুলো বলে গেল। আমি চুপচাপ শুনলাম সব। সেই পুরনো কথা, সেই পুরনো ঘটনা...আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এতো মানুষের সামনে...আমি কি অঝরের জীবনটা ওলটপালট করে দিলাম?? আমার জন্যই তো আম্মুর সাথে ওর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল!

আমি উঠে দাঁড়ালাম। অঝর এখনো আড্ডায় ব্যস্ত। কিন্তু এই ঘরের ভেতর আমার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।

অঝর, একটু শুনবে?”

অঝর আমার দিকে তাকাল। ওর চোখ-মুখে এখনো হাসির রেখা।

কি হয়েছে শ্রাবণ?”
আমার ঠিক ভালো লাগছে না। বাসায় যাবো।
এখনি??”
হুম।

অঝরের মনটা যে একটু খারাপ হয়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার। কিন্তু আমার পক্ষে আর এখানে থাকা সম্ভব না।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম ওখান থেকে। বাইরের বাতাসটা যেন প্রাণ জুড়িয়ে দিল আমার। অঝর ড্রাইভ করছে। আমি জানালার কাচ পুরোটা নামিয়ে দিলাম। দমকা হাওয়ায় আমার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্ট আর গাছগুলো সাই সাই করে পিছে ছুটে যাচ্ছে। আমি দেখছি ওদের ছুটে যাওয়া। আমারও ওদের সাথে ছুটতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ করে অঝরের কণ্ঠ শুনে খানিকটা চমকে উঠলাম।

কি হয়েছে শ্রাবণ? তারেকের বাসা থেকে চলে আসতে চাইলে, বের হওয়ার পর একটা কথাও বল নি! কি হয়েছে বলবে?”
কিছু না।
আমার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছো?”

আমি অঝরের দিকে তাকালাম। আমার চোখ ছলছল করছে। শান্ত কণ্ঠে বললাম,

তুমি প্লিজ ঠিকমতো ড্রাইভ করো।

অঝর আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগলো। সিডি প্লেয়ার থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত মৃদু সুর...

বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে...
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যালোকে...

অন্যসময় হলে এই গানটা শুনেই আমি গুনগুন করতে শুরু করতাম। কিন্তু আজ কিছুতেই সুরটা ধরতে পারছি না।

আমার মন খারাপ দেখে অঝরের কষ্ট হচ্ছে জানি। কিন্তু আমি কিছুতেই ওই কথাগুলো ভুলতে পারছি না। আমার জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। অঝরের বাইরে যাওয়াটা পর্যন্ত ক্যান্সেল হয়ে গেল। সবকিছুর জন্য তো আমিই দায়ী.........হঠাৎ করে ব্রেক করায় আমার চিন্তায় ছেঁদ পড়লো, বাসায় চলে এসেছি।

গাড়ি থেকে নামতেই দেখলাম মতিন মিঞ্চা দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিল ছেলেটা। আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম,
-
কি হয়েছে রে?
-আব্বা মইরা গেসে গো ভাবী।

আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার এখন কি বলা উচিত? কোন কথা বললে কি এই দুঃখের সান্ত্বনা হয়? আমি হাঁটু গেড়ে বসে পিচ্চিটাকে জড়িয়ে ধরলাম। কখন যেন আমার চোখ ভিজে গিয়েছে। দুখী মনটা আরও বেশি দুখী হয়ে গেল।

অঝর এগিয়ে এসে মতিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

মতিনের কান্নাকাটির মধ্যে দিয়ে যেটুকু বুঝতে পারলাম তা হল, দুপুর থেকেই ওর বাবার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বিকেলের দিকে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়, শুরু হয় রক্ত বমি। আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।

মতিনের জন্য খুব খারাপ লাগছিলো। আমি অঝরকে বললাম,
-
তুমি ওকে নিয়ে ওদের বাসায় যাও তো। ওখানে এখন তোমার দরকার হতে পারে।

অঝর ততক্ষণে গাড়ির স্টার্ট দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। আমি মতিনকে শান্ত করে গাড়িতে বসিয়ে দিলাম। অঝর দ্রুত বেগে গাড়ি ঘুরিয়ে বড় রাস্তার দিকে ছুটলো।

আমি কিছুক্ষণ ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে আজ খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকলাম। আলো জ্বালানো হয়নি বলে অনেকটা অন্ধকার হয়ে আছে সবকিছু। আমি বাতি জ্বালালাম না। আজ অন্ধকারে থাকতেই ভালো লাগছে। নিজেকে আজ খুব একা লাগছে। আব্বু-আম্মু আর রোদেলার কথা খুব মনে পড়ছে। রোদেলা থাকলে বকবক করেই আমার মনটা ভালো করে দিতো। আর আব্বু একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যেতো। আম্মুর বকুনিগুলোর জন্য আজ মন খারাপ হচ্ছে, মনে হচ্ছে এখনই আম্মু এসে আমাকে খুব করে বকে দিক। পুরোটা বাসায় আমি একা। একাকীত্ব জিনিসটা আজ খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে।

মানুষ মরে গেলে তো সব মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে যায়, তাই না? আমি যদি মরে যাই তাহলে কি অঝর আমাকে এভাবেই ভালবাসবে? আব্বু-আম্মু-রোদেলা কি আমাকে মনে করে কাঁদবে? আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে, চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম।

হঠাৎ করেই ঘরটা আলোকিত হয়ে গেল। অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসে থাকায় আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা হচ্ছিলো আমার। চোখ পিটপিট করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি অঝর দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

-
চলে এসেছ তুমি? কি অবস্থা ওদের?
-
কি আর অবস্থা হবে বলো! কান্নাকাটি করছে সবাই। কিছুদিন পরেই মতিনের বড় বোনটার বিয়ে। মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদছে। ওর কান্না দেখে আমারই চোখ ভিজে গিয়েছিলো। কেন যে এমন......
অঝর ওর কথা শেষ করার আগেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অঝর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আর আমি চিৎকার করে কাঁদছি...

-
আব্বু-আম্মুর কথা মনে পড়ছে, তাই না??

আমি মাথা নাড়লাম।

-
এভাবে বোকা মেয়ের মতো কাঁদে নাকি! যাও তো, ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো।
-
এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
-
উহু, কোন কথা না। যাও ফ্রেশ হও।

আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এই মুহূর্তে আমার ওর সাথে তর্ক করার কোন ইচ্ছা নেই। ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। পানির ট্যাপ ছেড়ে চোখে মুখে পানি দিলাম। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমার কি এসময়ে এতো বেশি স্ট্রেস নেওয়া উচিৎ? আমার ভেতরে যে নতুন একটা প্রানের অস্তিত্ব টের পেয়েছি, তার ভালোর জন্য নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখা আমার দায়িত্ব। নাহ, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু হবেও না। ভেবেছিলাম আজ বাসায় ফিরবার পর অঝরকে এই খুশির খবরটা দিয়ে চমকে দিবোকিন্তু সব প্ল্যান ভেস্তে গেল, সবকিছু এক মুহূর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল। অনেক সময় আশেপাশের কিছু মানুষের দুঃখ-কষ্টগুলো আমাদের আনন্দের উপর ভারী হয়ে ধরা দেয়। তখন আর নিজেদের আনন্দগুলোও মনে দোলা দেয় না।

-
শ্রাবণ, এতক্ষণ ধরে কি করছো!
অঝর দরজায় নক করছে। আমি তাড়াতাড়ি হাত মুখ মুছে বেরিয়ে এলাম।
-
মেয়েদের নিয়ে এই একটাই সমস্যা, আয়না সামনে পেলে আর সময়জ্ঞান থাকে না!
ওর কথা শুনে আমি একটু হাসলাম।
-
যাক, এতক্ষণ পর তোমার হাসি দেখলাম। এখন চল আমার সাথে। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজের কথা শুনে আমি একটু চমকে উঠলাম। সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা তো আমার ছিল। কিন্তু...

অঝরের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যেন নিয়ে যেতে চাইছে আমাকে। জিজ্ঞেস করি নি কোথায়। আমার মন ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে মানুষটা। তার এই চেষ্টা দেখেই আমার মন অর্ধেকটা ভালো হয়ে গিয়েছে। অর্ধেকটা এখনো খারাপ রেখেছি ওর সারপ্রাইজের জন্য।

গাড়িটা আবার ছুটে চলছে। আমি গাড়ির জানালা থেকে জোছনা দেখছি।
-
অঝর, তোমাকে আমি আজ তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সারপ্রাইজটা দিবো......আপনমনেই কথাটি বলে ফেললাম।
-
তুমি কি কিছু বললে শ্রাবণ?
-
উহু...আমি আবার জোছনা দেখায় মন দিলাম... 

ojhor srabon dhara.jpg         “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (৪র্থ পর্ব)
                                    ||শ্রাবণের কথা||

ঝরের সারপ্রাইজটা আমার মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি করলো। এই মুহূর্তে আমার কিভাবে রিঅ্যাক্ট করা উচতি সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি আমাদের বাসার দরজায়, মানে আমার বাপের বাড়িরসদর দরজায়! আব্বু-আম্মুর জন্য খুব খারাপ লাগছিলো বলে অঝরের এই উদ্যোগ! আমি অঝরের দিকে তাকালাম,

-
অঝর, এখানে...কেন?
-
বিয়ের পর তো আমার শ্বশুরবাড়ি আসা হয় নি, তাই...

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ এমন হয় কিভাবে?? একজন মানুষ এতো ভালো হয় কিভাবে??

-
কিন্তু আব্বু-আম্মু কি আমাদের...

আমার কথা শেষ হতে না হতেই অঝর কলিং বেল টিপে দিল!! আমার বুকটা ধুকপুক করছে। প্রায় ছয়মাস পর আব্বু-আম্মুকে দেখব, রোদেলা নিশ্চয়ই এই ছয় মাসে আরও সুন্দর হয়েছে...

দরজা খোলার শব্দ হল। দরজাটা খুলে যেতেই আম্মুর মুখটা দেখতে পেলাম। আমাকে দেখে আম্মু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি আস্তে করে বললাম,

-
আম্মু, কেমন আছো?

আম্মু কোন উত্তর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আম্মুর কান্না দেখে আমি আর ঠিক থাকি কিভাবে! আমিও আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

আমি আম্মুর চোখ মুছিয়ে দিলাম। আম্মুর কান্না তবুও থামে না, কান্নার জন্য কিছু বলতেও পারছে না। আম্মুকে ধরে ভেতরে সোফায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-
আব্বু আর রোদেলা কোথায় আম্মু?

আম্মু ততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে।

-
তোর আব্বু শুয়ে পড়েছে। আর রোদেলা ওর রুমেই আছে, পড়ছে। পরীক্ষা চলে।
-
আম্মু তুমি কেমন আছো? আমার উপর তোমার খুব অভিমান, তাই না?
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আহ, এই স্নেহের পরশ পাওয়ার জন্য কতদিন অপেক্ষা করেছি।
-
তুই কেমন আছিস শ্রাবণ?
-
অঝর আমাকে অনেক ভালবাসে আম্মু।

আমার এই কথাটা শুনে আম্মুর মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছায়া দেখতে পেলাম।

-
মা রে, আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি রে। কি করবো বল? যখন কেউ তোর সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলতো
তখন যে আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যেতো। তাই তোর উপরেই সব রাগ ঝারতাম। আজ তোর হাসি মুখ দেখে বড্ড শান্তি পেলাম রে মা। আমাকে ক্ষমা করিস...

আমি আম্মুর হাত চেপে ধরে বললাম,

-
আম্মু, চুপ করো তো। আমি কি বুঝি না তোমার কেমন লাগতো? তোমার চোখের জল আমি দেখেছি আম্মু।

আম্মু আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। হঠাৎ করে পেছন দিক থেকে একটা চিৎকার শুনলাম... আপুউউউউউউ।

আমি পেছন ফিরতেই রোদেলা আমার উপর একরকম ঝাঁপিয়েই পড়লো!!

-
আপু তুমি কেমন আছো?? এতদিন পর আমাদের কথা মনে পড়লো?? আমার কথা একবারও মনে পড়ে নি??

আরেক দফা কান্নাকাটি শুরু হল। আম্মু আর রোদেলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমিও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এই দৃশ্য দেখে অঝর মিটিমিটি হাসছে।
আমি রোদেলাকে ভালোমতো দেখলাম।

-
আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। এই কয়দিনে তুই আরও সুন্দরী গেছিস। আম্মু তোমার মেয়েটাকে দেখে রেখ কিন্তু। ও তো দিন দিন ভয়ংকর সুন্দরী হচ্ছে।
-
ধ্যাত, তুমি যে কি বল না আপু!

এই বলে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমার পাগলী বোনটা।

চিৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটির শব্দ শুনেই আব্বু পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। আমাদের এই অবস্থা দেখে আব্বুও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অঝরের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম অঝর আস্তে করে আব্বুকে কি যেন বল। আব্বুর চোখ তখন চিকচিক করছে।

নিজেকে আজ সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে। কোন কিছুর অভাব নেই, কোন দুঃখ নেই, কোন কষ্ট নেই। সব আজ ভাসিয়ে দিলাম চোখের জলে। মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে অপ্রত্যাশিতভাবেই অনেক কিছু ঘটে যায়। ঐ ব্যপারগুলো কখনো আমাদের আনন্দ দেয় আর কখনো বা কাঁদায়। আজ আমার জীবনের অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি আমাকে যতটা আনন্দ দিচ্ছে, মতিনের জীবনে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি নিশ্চয়ই তাকে সেই পরিমান কিংবা তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

আমরা আসার আগেই রাতের খাবারটা খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো সবার। তবুও আম্মু আয়োজন করে টেবিল সাজাতে শুরু করলো। যতই হোক, মেয়ে জামাই প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছে! আমিও আম্মুর কাজে হাত লাগালাম।
আব্বু টিভি দেখছে, আর অঝর... তার তো শ্বশুরবাড়ি এসে ভাব বেড়ে গিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে উনি আমকে চেনেনই না! নিজেই ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। রোদেলার সাথে হাসির মেলা জুড়ে দিচ্ছে। আব্বুর সাথে এমনভাবে আলাপ জমিয়েছে যেন সবাই তার কতদিনের চেনা।

আমি আম্মু আর রোদেলার কাছে বারবার জানতে চাইছিলাম ঐদিনের ব্যাপারে। আমি এভাবে অঝরের সাথে চলে যাওয়ায় কি অবস্থা হয়েছিলো কে জানে? কিন্তু দুজনের কেউই এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলছে না! আম্মুর একটাই কথা,

-
পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছিস কেন রে?? তোরা দুজন সুখে আছিস এটাই তো আসল, তাই না?
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি। শুধু কেন জানি আজ চোখ দুটো বারবার ভিজে যাচ্ছে।

আব্বু আম্মু রোদেলা সবাই আমাদের ঘিরে বসে আছে। অঝরকে তো পুরোপুরি জামাই আদর করা শুরু হয়েছে। আম্মু আর রোদেলা মিলে একের পর এক খাবার ওর প্লেটে তুলে দিচ্ছে। আহারে বেচারা, খেতে খেতে হাঁপিয়ে উঠেছে। ওর অবস্থা দেখে আমি আর রোদেলা হাসতে হাসতে শেষ।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতে হতে ১২টার মতো বেজে গেল। আমার রুমে তো এখন রোদেলার রাজত্ব। তাই আম্মু গেস্টরুমটা খুলে ঠিকঠাক করে দিল। আম্মুর সাথে সব গোছগাছ করে রুমে গেলাম। রুমে ঢুকেই অঝরকে বললাম,

-
আমার সাথে একটু ছাদে চল তো।
-
এখন না শ্রাবণ, খুব ঘুম পাচ্ছে।
-
উহু, এখনই।
-
প্লিজ শ্রাবণ, আমি আজ খুব ক্লান্ত। এখন কোন পাগলামি করো না।
-
যাবা না তুমি??
বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে।
-
আচ্ছা, যাচ্ছি। শান্তি?
-
হ্যাঁ, শান্তি
বলেই হাসতে হাসতে ওর গাল টেনে দিলাম।

ভরা পূর্ণিমা আজ। আমি আর অঝর ছাদের দোলনাটায় বসে আছি। আকাশের মস্ত বড় চাঁদটা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।
নীরবতা ভেঙ্গে অঝর বলল,

-
হুম, বল।
-
কি বলবো?
-
যা বলবার জন্য এই মাঝরাতে ছাদে নিয়ে এসেছ, সেটা।
-
আজকের সারপ্রাইজটার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ।
-
তুমি আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে ছাদে উঠিয়েছ??
-
আহা, এতো অস্থির হোচ্ছ কেন অঝর বাবু??
-
আচ্ছা, আমি শুনছি। বল।
আমি চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না।
-
অঝর...
-
বল শ্রাবণ। আমি শুনছি।
-
তোমার জন্যও আমার কাছে একটা সারপ্রাইজ আছে।
-
সারপ্রাইজ??
অঝর কিছুটা অবাক হয়েই আমার দিকে তাকাল।
-
হুম। এক বছর আগেও আমাদের কোন গল্প ছিল না। আমি তোমাকে চিনতাম না, তুমিও আমাকে চিনতে না। এরপর আমাদের পরিচয় হল, বন্ধুত্ব হল, দুজন ভালবাসার বাঁধনে জড়ালাম। অঝর-শ্রাবণের গল্প শুরু হল।
আমি একটু থামলাম। অঝর বলল,
-
থামলে কেন?
-
একটা নতুন গল্প শুরু হতে যাচ্ছে অঝর।
-
নতুন গল্প? মানে?
-
হ্যাঁ, নতুন গল্প। অঝর-শ্রাবণ-ধারার গল্প...
-
অঝর-শ্রাবণ-ধারার গল্প...মানে...

অঝর বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ওর চোখ আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। আমি ওর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদটা এখনো হাসছে। ভরা পূর্ণিমার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি আমরা দুজন, ভেসে যাচ্ছি অনেক দূরে...





ojhor srabon dhara.jpg            “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (৪র্থ পর্ব)
                                     ||অঝরের কথা---||

শ্রাবণকে নিয়ে ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আর পাগলী শ্রাবণটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ও হয়তো কল্পনাও করতে পারে নি, ওকে নিয়ে ওদের বাসায় আসবো। পাগলীটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আমি। পাগলীটা বলে উঠলো-

-অঝর, এখানে...কেন?
-
বিয়ের পর তো আমার শ্বশুরবাড়ি আসা হয় নি, তাই...
-
কিন্তু আব্বু-আম্মু কি আমাদের...

কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল শ্রাবণের আম্মু। শ্রাবণকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো আর শ্রাবণ তো এবার সুযোগ পেয়ে কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো। পুরো দমে পাগলী আমার শ্রাবণটা, কোথায় আম্মুকে সান্ত্বনা দিবে- তা না, বরং আম্মুর কান্নার পরিমাণটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আম্মু যেন কি ভাববে, তার মেয়েটাকে না জানি কত কষ্টে রেখেছি!!! আমি দর্শকের মত দূর থেকে দাঁড়িয়ে মা আর মেয়ের কাণ্ড-কীর্তি দেখছি। শ্রাবণ কান্নার রেশ রেখে বলল-

-
আব্বু আর রোদেলা কোথায় আম্মু?

আম্মু ততক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছে।

-তোর আব্বু শুয়ে পড়েছে। আর রোদেলা ওর রুমেই আছে, পড়ছে। পরীক্ষা চলে।
-
আম্মু তুমি কেমন আছো? আমার উপর তোমার খুব অভিমান, তাই না?
__________________________

আমি মা আর মেয়েকে গল্প করার সুযোগ দিয়ে পাশের ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এই মুহূর্তে শ্রাবণ রোদেলাকে অনেক মিস করছে, তাই ওকে ডেকে আনতে যাচ্ছি। ঘরের দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও নক করলাম-
-
শ্যালিকা, মে আই কাম ইন?
রোদেলা অনেকটা চমকে গিয়ে তাকালো। কি করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল।
-
অঝর ভাইয়া, আপনি?
-
হ্যাঁ আমি, কেমন আছেন আপনি? পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?
-
জি ভাইয়া, ভাল আছিআর পরীক্ষাও ভাল হচ্ছে। আপু কোথায়?
-
কোথায় আবার! মা আর মেয়েকে আজ কান্না ভূত ভর করেছে, সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছেতুমিও গিয়ে দেখে আসো।

শ্রাবণের কথা শুনে দৌড়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। আমিও বের হলাম, গিয়ে দেখি দুই মেয়ে আর মা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছেআমি পুনরায় দর্শক হয়ে রইলাম।

তখন আমার বয়স দশ কি নয়! বর্ষা কাল, প্রতি বর্ষার মত সেবারও ছুটি কাটাতে আমাদের বাংলো বাড়িতে গেলাম। কেন জানি না, কোন এক ফ্রেন্ডের মুখে সাঁতার কাটার গল্প শুনে আমিও জেদ ধরলাম সাঁতার কাটা শিখবো। বাবা অনেকবার না করেও যখন বুঝতে পারলেন যে, তার না দিয়ে কোন কাজ হবে না তখন কাদের চাচাকে (মতিন মিঞ্চার বাবা) ডেকে পাঠালেন। তার হাতেই আমাকে সাঁতার কাতা শিখানোর দায়িত্ব অর্পণ করলেন। বাসার পাশেই নদী, সেই নদিতেই চলতো আমার সাঁতার কাটা শেখার মিশন। খুব অল্প দিনে বেশ ভালই শিখে ফেলেছিলাম সাঁতার কাটা। নিজে নিজে সাঁতার কেটে নদীর মাঝখানে চলে যেতাম, আবার ফিরেও আসতে পারতাম।

একদিনের ঘটনা, বাইরে প্রচণ্ড শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। আর বাবা গত কাল রাত থেকেই জরুরী এক কাজে বাসা থেকে বাইরে আছে। কেন যেন খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সাঁতার কাটতে। কাদের চাচাকেও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না, তাই একাই বের হলাম নদীতে সাঁতার কাটতে। নদীতে সাঁতার কাটছি, জোয়ার-ভাটার মৌসুম এবং ঝর বৃষ্টির কারনে স্রোতের পরিমাণটা অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি। নদীর প্রবল স্রোত আমাকে অনেক দূর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও আমি পাঁড়ের কাছে যেতে পারছি না। সাঁতরাচ্ছি আর সাঁতরাচ্ছি, এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে হঠাৎ করেই রাজ্যের ঘুম চলে এলো। এরপর আমার আর তেমন কিছুই মনে নেই, কতদূর ভেসে গিয়েছিলাম তারও কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই দেখি আম্মু আমার পাশে বসে আছে, আর শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। আমার আর বুঝতে বাকী রইলো না যে আজ আমার এক ছেলে মানুষীর জন্য আম্মুকে কতটা কষ্ট পেতে হয়েছে। এরপর থেকে আর কোন দিন একা নদীতে সাঁতরাতে যাই নি। আম্মুর কাছ থেকে শোনা, কাদের চাচা নাকি ঐ প্রচণ্ড ঝর-বৃষ্টির মধ্যে আমাকে খুজতে বের হয়েছিলেন আম্মুর কথা শুনে। এরপর চাচা আমাকে নিয়ে সরাসরি বাসায় আসেন, তখন নাকি আমার অবস্থা গুরুতর ছিল। চাচা এই বৃষ্টির মধ্যে কোথা হতে যেন ডাক্তার নিয়ে আসেন। নইলে আজ হয়তো আমার এখানে থাকা হত না। চাচার কাছে একটা প্রশ্ন ছিল- চাচা আমাকে কিভাবে বা কোথায় পেয়েছিলেন? কিন্তু প্রশ্নটা আর কখনো করা হবেও না। মনটা যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল।

আজকের রাতের আকাশটা অনেক বেশি সুন্দর। চাঁদের আলোয় পুরো শহর আলোকিত হয়ে আছে। বারান্দায় লাগানো ক্যাকটাস গুলোর ছায়া অন্ধকার ঘরের ভেতর এসে যেন ভূতুরে আকার ধারন করেছে। আর রোদেলা খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য ঐ ঘরের কাছে নিয়ে এলো। প্রথমে কিছুটা আঁতকে উঠলেও কিছুক্ষনের মধ্যে বুঝতে নাকি রইলো না, এটা ক্যাকটাস ছাড়া অন্য কিছু না। বারান্দায় দাড়িয়ে শ্যালিকার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।

-
শ্যালিকা এত দিন পর বোনকে কাছে পেয়ে কেমন লাগছে?
-
অঝর ভাইয়া, আপনি মোটেও ভাল মানুষ না। কত দিন হয়েছে আমি আপুকে দেখি না জানেন? ৬ মাস ১৩ দিনএত দিন আমাকে আপুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে কি মজা পেয়েছেন?
-
কি করবো বল রোদেলা, তোমার আপুই তো আসতে চায় নি, বলেছে ঐ কুটনা বোনের সাথে আর দেখাই করবে না, আমিই তো জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে এলাম এবার। নইলে তো এবারও আসা হত না।
-
অঝর ভাইয়া এগুলো কিন্তু ঠিক না, বোনদের মধ্যে প্যাঁচ লাগানোর ষড়যন্ত্র করছেন?
-
বোনের মত তুমিও পাগল। বলেই হাসতে লাগলাম।
শ্রাবণের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আমাকে আর রোদেলাকে খেতে ডাকছে। আমি রোদেলাকে বললাম-
-
দেখলে তো তোমার বোনটার সময় জ্ঞান নেহাতই শূন্যের কাছাকাছি। দুলাভাই আর শ্যালিকার কথোপকথনের মধ্যেও বাঁধ সাধল।
-
অঝর ভাইয়া!!!

খাবার টেবিলে বসে আছি। চোখের সামনে টেবিল ভর্তি রাজ্যের খাবার। যদিও আমরা আসার আগেই শ্রাবণদের বাসার সবাই খেয়ে নিয়েছে, তাই খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তবুও অনেকটা জোর করেই খেতে হচ্ছে। শ্রাবণের আব্বু আম্মু রোদেলা সবাই এক সাথে বসে খাবার খাওয়ার অন্য রকম আনন্দ। আব্বু-আম্মুকে অনেক বেশি মনে পড়ছে। খেতে খেতে আমার অবস্থা কাহিল, এটা শেষ না হতেই ওটা প্লেটে তুলে দিচ্ছে রোদেলা। আর তা দেখে শ্রাবণের কি যে হাসি!!! পুরোই পাগলী। এরই মধ্যে শ্রাবণের আব্বুর সাথে নানা বিষয়ে কথা জুড়ে দিলাম। আর ঐদিকে মা আর মেয়েরা মিলে কি নিয়ে যেন গল্প করছে।

খাওয়া শেষে হতে না হতেই শ্রাবণের সাথে ছাদে যেতে হবে বলে শ্রাবণের বায়না। আমারও যে ছাদে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তা কিন্তু না। তবে এমন ভাব ধরলাম যাতে অনেক অনীহা নিয়ে ছাদে যাচ্ছি।

আজকের চাঁদটা যততা না আমাকে মুগ্ধ করছে। তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হচ্ছি শ্রাবণের কর্ম-কাণ্ড দেখে। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। আমার দিকে যেন তার কোন নজরই নেই। ওকে এভাবে দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীরবতা ভেঙ্গে বললাম,

-
হুম, বল।
-
কি বলবো?
-
যা বলবার জন্য এই মাঝরাতে ছাদে নিয়ে এসেছ, সেটা।
-
আজকের সারপ্রাইজটার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ।
-
তুমি আমাকে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে ছাদে উঠিয়েছ??
-
আহা, এতো অস্থির হচ্ছো কেন অঝর বাবু??
-
আচ্ছা, আমি শুনছি। বল।
শ্রাবণ যেন কি ভাবছে। ওকে অনেকটা চিন্তিত লাগছিল। চিন্তার রেশ ওর সারা মুখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। হঠাৎ বলে উঠলো-
-
অঝর...
-
বল শ্রাবণ। আমি শুনছি।
-
তোমার জন্যও আমার কাছে একটা সারপ্রাইজ আছে।
-
সারপ্রাইজ?? সারপ্রাইজের কথা শুনে অনেকটা চমকে উঠলাম। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
-
হুম। এক বছর আগেও আমাদের কোন গল্প ছিল না। আমি তোমাকে চিনতাম না, তুমিও আমাকে চিনতে না। এরপর আমাদের পরিচয় হল, বন্ধুত্ব হল, দুজন ভালবাসার বাঁধনে জড়ালাম। অঝর-শ্রাবণের গল্প শুরু হল।

এটুকু বলেই থেমে গেল শ্রাবণ। আমার কৌতূহলটা বেড়েই যেতে লাগলো।

-
থামলে কেন?
-
একটা নতুন গল্প শুরু হতে যাচ্ছে অঝর।
-
নতুন গল্প? মানে? আমার কৌতূহলটার যেন বাঁধ যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি আর টিকতে পারছি না।
-
হ্যাঁ, নতুন গল্প। অঝর-শ্রাবণ-ধারার গল্প...
-
অঝর-শ্রাবণ-ধারার গল্প...মানে...

আমি কিছুতেই কিছু মিলাতে পারছি না।
অবাক বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর আমি কৌতূহলের সাগরে তখন পুরোপুরি নিমজ্জিত।



















ojhor srabon dhara.jpg          “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (শেষ পর্ব)
                                    ||অঝরের কথা---||

ফিসের কাজের চাপে বাঁকা হয়ে যাবার অবস্থা। দম নেয়ারও সময় পাচ্ছি না। মিটিং শেষে নিজের অফিসে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। রেলিং এর গা ঘেঁষে বেড়ে উঠা একটি হিজল গাছের উপর কাকদের সভা চলছে। মানুষের গণসভায় যেমন একের পর একজন এসে বক্তৃতা দিয়ে যায় এবং উপস্থিত সবাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত তালি দিতে বাধ্য হয়। এখানেও ঠিক একই কাহিনী ঘটে, তবে পার্থক্য শুধু এতটুকুই হাত তালি দেওয়ার বদলে সুকন্ঠি গান শোনা যায়। মাথার রক্ত গরম হয়ে চরম পর্যায়ে উঠেছে। আজ একবার আরামবাগের চিপা হতে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। গণি ভাইকে বললেই হয়তো একটা রিভালবার জোগাড় করা যাবে। এক-এক করে বিরক্তিকর সবগুলো কাককে গুলি করে মারার ইচ্ছেতা আমার অনেক পুরনো।

সেদিনের ঘটনা, রোদেলা তখন বাসায়। পরীক্ষা শেষে বেড়াতে এসেছে। শ্রাবণ আর রোদেলাকে নিয়ে বের হয়েছিলাম বালুর চরের উদ্দেশ্যে। পড়ন্ত বিকেলে বালুর কণাগুলো চিকচিক করছে। নদীর জলে পালতোলা রাঙ্গা নৌকার পাল। চরের উপর বিস্তীর্ণ কাশবন। শ্রাবণের অনেক পছন্দের এই কাশবন। শ্রাবণ খালি পায়ে বালুর উপর দিয়ে হাঁটছে, হাতে ওর একমুঠো কাশফুল। শ্রাবণের পিছুপিছু হাটছি আমি আর রোদেলা। শ্রাবণের আনন্দ আর বিস্ময় দেখে নিজের মধ্যেঅ কিছুটা আনন্দের আভা দোল খেতে লাগলো। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা, পড়ন্ত সূর্য নদীর জলকে আর মাঝির মনকে বিষণ্ণ করে তুলেছে। অদূরে পাল তোলা নৌকো থেকে মাঝির গান শোনা যাচ্ছে-


তোমার নাম লইয়া ধরিলাম পাড়ি,
অকূল দরিয়ায়, সাঁই, সাইরে.....।
মাঝি বাইয়া যাওরে......
অকূল দরিয়ার মাঝে,
আমার ভাঙ্গা নাও.....।'
আবার ভব সিন্ধু পাড়ে......
দয়াল পার কর আমারে.....



শ্রাবণকে দিনে কতবার করে জ্বালাতন করি, তার হিসেব নেই। একটু পরপরই ফোন দিয়ে খবর নেওয়া হয়, কি করবো? একা একা থাকতে থাকতে হয়তো বোর হয়ে যাচ্ছে আমার বউটা। কিছুদিন রোদেলা এসে থেকে গেলেও ক্লাস শুরু হওয়ায় চলে যেতে হয়েছে ওকে। আর মতিন মিঞ্চা এখনো ওদের বাড়িতেই। সেদিন গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। মা আর ছেলে বেশ ভালই আছে এখন। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। শ্রাবণের কথা জিজ্ঞেস করলো। চাচীর সাথেও দেখা করে এলাম। চাচী শ্রাবণের জন্য দোয়া করে দিলেন। শ্রাবণকে দেখেছিলেন মেয়ের বিয়েতে। শ্রাবণ এই শরীর নিয়েও ঝর্নার (মতিন মিয়ার বোন) বিয়ের জন্য চুরি থেকে শুরু করে শাড়ি পর্যন্ত যাবতীয় কেনাকাটা করে দিয়েছে। ও হ্যাঁ, বলাই তো হয় নি, ঝর্নার বিয়ে হয়েছিল সময় মতই। বিয়ের যাবতীয় খরচ আব্বু দিয়েছে আর আমি মাঝে মাঝে এসে কাজের অগ্রগতি দেখে যেতাম। মতিন মিঞ্চার মুখে শুনলাম মেয়েটা নাকি বেশ সুখেই আছে।

কাকসভা শেষ। তাই আজও আরামবাগ যাবার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল। কাকসভা শেষ হবার ঠিক আগমুহূর্তে সবকটা কাক মিলে এতই সুরেলী কন্ঠে গান গেয়ে উঠলো যে, ভাবনার রেশ একদমই কেটে গেল। শ্রাবণকে একটা ফোন দেওয়া দরকার। ওকে নিয়ে আজ ওদের বাসায় যাওয়ার কথা। এখানে দেখা-শুনা করার মত কেউ নেই, তাই এই সময়ে ওদের বাসাটাই সবচেয়ে সেফ ওর জন্য। ওকে রেডি হবার জন্য তাগাদা দিতে ফোন দিলাম-

-তুমি রেডি তো? আমি একটু পরই বের হবো।
-
হ্যাঁ, আমার সব কাজ শেষ। তুমি তাড়াতাড়ি চলে...

শ্রাবণের কথা শেষ হতে না হতেই ওর চিৎকার শুনতে পেলাম। বারবার শ্রাবণ শ্রাবণ করে ডেকে যাচ্ছি কিন্তু ওপাশ থেকে কোন কথায় আসছিল না। অফিস থেকে দৌড়ে বের হলাম। গাড়ি নিয়ে খুব দ্রুতই পৌঁছে গেলাম বাসায়। গেট দিয়ে ঢুকতেই ট্রি-হাউজের নিচে শ্রাবণকে পড়ে থাকতে দেখলাম। ওর চারপাশে যেন রক্তের বন্যা বয়ে গেছে। আর ট্রি হাউজে উঠার মইটা ওর পাশে পড়ে আছে। কোন মতে ওকে গাড়িতে তুললাম। আমার মাথায় শুধু এখন একটাই চিন্তা কত তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া যায়।

আট ঘন্টা হয়ে এলো শ্রাবণের জ্ঞান এখনো ফেরে নি। আমি কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছি, আমার পাশেই রোদেলা বসে আছে। ওর চোখে চিন্তার রেশ ফুটে উঠেছে। আর শ্রাবণের আম্মু শ্রাবণের কেবিনের উপর ঠিক ওর পাশে বসে আছে, সারাটা দিন কেঁদে কাটিয়েছেন তিনি। আর রোদেলাও মার সাথে গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেছে। পাগলের গুষ্টিতেই যে কেন বিয়ে করলাম আল্লাহ্‌ মালুম। বাবা-মাকে খবর পাঠিয়েছিলাম, বাবা আসলেও মা আসেনি। আর শ্রাবণদের বাসায় খবর পাঠালে আম্মু,আব্বু আর রোদেলা আসে। ডাক্তার এসে জানিয়ে গেছে শ্রাবণ কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পাবে, তবে যে কথাটি শুনে আমি স্তব্ধ হয়েছিলাম কিছুক্ষণ, সেটা হলো- আমাদের ধারা মামনি আর নেই। প্রচণ্ড রক্তপাতের কারনে এমনটা হয়েছে। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে, শ্রাবণ আর কখনো মা হতে পারবে না। আমি যেন পাথরের মত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আমার শ্রাবণটার জন্য বড্ড খারাপ লাগছে। ওর এত সাধের পুতুলটা এই পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই বিদায় নিলো। কিছুতেই হয়তো এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবে না ও। হয়তো ও নিজেকে অনেক বেশি অপরাধী ভাববে, কিন্তু সত্যি বলতে আমার শ্রাবণকে ছাড়া আর কিছু লাগবে না।

তারেককে ফোন দিয়েছিলাম সেদিন। রুপন্তির সাথেও কথা হয়েছিল। ঐ দিনের সেই ঘটনার জন্য সরি বলেছি। রুপন্তি বলেছে আমাদের ধারা মামনি আসলে একবার আমাদের বাসা হতে ঘুরে যাবে তারেককে নিয়ে। আর আমাদের ধারার জন্য অনেক অনেক দোয়া করে দিয়েছিল সেদিন। রুপন্তিকে অনেক সুখী মনে হল সেদিন। তারেককে একটা ধন্যবাদ দিলাম, ও একটা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। একটা মানুষকে সুখী রাখা সবার দ্বারা সম্ভব না, আর যে সেটা পারে, তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। রুপন্তির জন্য তারেককে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে, অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ভালবাসার জালটা ছিড়ে যেতে দেয় নি ও। মাঝে মাঝে মনে হয় ইশ, তারেকের মত হলে ভালই হত। ও ওর রুপন্তির জন্য কত কিছুই না করেছে। আর আমি!!! খুব হিংসে হয় ওকে।

এর কিছুদিন পর শায়না মেয়েটা ফোন দিয়েছিল। ফোন দিয়ে কিছুক্ষণ কান্না-কাটি করলো। ও সেদিনের ঘটনা পুরোটা আমাকে খুলে বলল আর এর জন্য অনেক বেশি দুঃখ প্রকাশ। শ্রাবণকে ফোন দেওয়ার মত সাহস নাকি ওর নেই। তাই আমার কাছেই ক্ষমা চেয়ে নিল। ওর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গিয়েছে। বিয়েতে শ্রাবণকে নিয়ে যেতে বলেছে। হয়তো শ্রাবণ ভাল হলে ওকে দেখতে যাবো একবার।

আর হিমেলের খবর পাই না অনেক দিন। শুনেছি ও নাকি নতুন করে জীবন শুরু করেছে চন্দ্রাকে নিয়ে। প্রতি শুক্রবার একবার করে চন্দ্রার কবর যিয়ারত করতে যায়। বাবা রিটায়ার্ড নেওয়ার পর থেকে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এখন ওর কাঁধে। ছোট ভাই আর বোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব ওর উপর পড়েছে। চন্দ্রার মৃত্যুর পর একবার ওর কাছে গিয়েছিলাম। ওকে আমার জামানো প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এসেছিলাম নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য। কিছুতেই নিতে চায় নি ও। বলে এসেছি, শালা তোকে তো টাকাগুলো একেবারে দিয়ে দিচ্ছি না, ধার দিচ্ছি। যখন তুই বুড়ো হয়ে কুঁজো হয়ে যাবি, তখন আসবো পাওনা টাকা ফিরিয়ে নিতে। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল সেদিন।

শ্রাবণের জন্য খুব খারাপ লাগছে। আমি কেবিনের দিকে আগালাম। মনে হচ্ছে ওর জ্ঞান ফিরেছে। আম্মুর সাথে যেন কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে ও। কেবিনে ঢুকতেই কিছু উত্তর না জানা প্রশ্ন দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হলাম-

-
অঝর আমার ধারা কোথায়? আমার মামনিটা কোথায়?
এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিল না। আমি ওকে শান্ত করার জন্য বললাম-
-
শ্রাবণ, প্লিজ এমন করো না। তুমি এখনো সুস্থ হও নি। এমন করলে তোমার শরীর আরও খারাপ করবে। একটু শান্ত হও।
-
আমার ধারা কোথায় অঝর? তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন? আমার বাবুটার কিছু হয় নি, তাই না? প্লিজ বল যে আমার বাবুটার কিছু হয় নি...প্লিজ...
আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে মেঘের খেলা দেখতে লাগলাম। কেবিনের ভেতর থেকে আমার বউটার কান্নার আওয়াজ আসছে, আর তা বাতাসে মেঘের গর্জনের সাথে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার মেঘেদের দিকে মনোনিবেশ করলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদেলা গুণগুণ করছে-


নয়নে আমার সজল মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে, নয়নে লেগেছে।
নবতৃণদলে ঘনবনছায়ে
হরষ আমার দিয়েছি বিছায়ে,
পুলকিত নীপনিকুঞ্জে আজি
বিকশিত প্রাণ জেগেছে
নয়নে সজল সি্নগ্ধ মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে।

























ojhor srabon dhara.jpg        “অঝর-শ্রাবণ-ধারা" (শেষ পর্ব)
                                    ||শ্রাবণের কথা||

তো বড় একটা বাড়িতে আমি আর অঝর ছাড়া আর কেউ থাকে না। অঝর যখন অফিসে চলে যায় তখন খুব একা একা লাগে। মতিন এখনো ওদের গ্রামের বাড়িতেই আছে। ইশ, কবে যে আমার ধারা মামনিটা আমার কোলে আসবে! আমার পুতুলটাকে আমি কখনো কোলে থেকে নামাবোই না। ওর জন্য সুয়েটার বুনবো, ছোট ছোট মোজা বানাবো। কপালে সবসময় একটা কালো টিপ দিয়ে রাখব, কারো নজর লাগতে দিবো না......আমার চিন্তা ভাবনাগুলো মাঝে মাঝে আমাকেই লজ্জা পাইয়ে দেয়।

মাঝখানে কিছুদিন রোদেলা এসে আমার সাথে ছিল। কিন্তু আবার ক্লাস শুরু হওয়ায় ওকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। এখানে এসে যে কি খুশি হয়েছিলো মেয়েটা! সারাদিন একটাই কথা তার মুখে, “আপু, তোর এতো বড় রাজত্ব!!আর ট্রি হাউজটা দেখে তো ওর চোখ কপালে উঠে গিয়েছিলো! পারলে সারাদিন ট্রি হাউজেই কাটিয়ে দিতো। দুপুরবেলা অঝরের তেঁতুল বনে জোছনাবইটা নিয়ে ট্রি হাউজে উঠে বসতো।

আমাদের বাসার কাছেই একটা বালুর চর আছে। পাশেই আছে মস্ত এক কাশবন। অঝর আমাকে আর রোদেলাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলো। পড়ন্ত বিকেলে খালি পায়ে সাদা চিকচিকে বালুর মাঝে হেঁটেছিলাম সেদিন। খালি পায়ে বালুতে হাঁটার ব্যাপারটা যে এতো ইন্টারেস্টিং সেটা সেদিনই প্রথম জানলাম।

রোদেলা থাকায় বেশ ভালো লেগেছিল কয়েকদিন। ও চলে যাওয়াতে আবার একা একা লাগছে। আমাকে এই খালি বাসায় একা রেখে যেতে অঝরও ভীষণ ভয় পায়। এই সময়ে এভাবে একা থাকাটা একটু ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আর অঝরের অফিসে কাজের চাপটা এতো বেশি যে ও ছুটিও নিতে পারছে না।

সেদিন রাতের খাওয়া শেষে অঝর হঠাৎ করেই বলল,
-
শ্রাবণ, তোমাকে কাল তোমাদের বাসায় দিয়ে আসবো। ওখানে আম্মু আছে, উনি এসময় ঠিকমতো তোমার দেখাশোনা করতে পারবেন। কাজের চাপে তো আমি সারাদিনই বাইরে থাকি। তুমি এভাবে একা একা থাকো, খুব চিন্তা হয় আমার।
আমি ওর কথার বিরুদ্ধাচরন করলাম না। অঝর খারাপ কিছু বলে নি। আমার চিন্তায় ওর কাজেরও নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়।
আমি ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

সকালে অঝর বেশ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। আজ ওর একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বলল যে আমি যেন বিকালে রেডি হয়ে থাকি। অফিস থেকে ফিরেই ও আমাকে আম্মুর ওখানে দিয়ে আসবে।

অঝর চলে যাওয়ার পর আমি ঘর গুছাতে শুরু করলাম। ঘর গোছানো শেষে একটু রান্না বান্না করলাম।
গোসল সেরে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম, ঠিক তখন বেডরুমের ডান কোণে রাখা ডেস্কটার দিকে হঠাৎ নজর পড়লো, ‘তেঁতুল বনে জোছনাবইটা নেই। ডেস্কের দিকে এগিয়ে খোঁজাখুঁজি করলাম কিছুক্ষণ। নাহ, পেলাম না। বইটা অঝর প্রায়ই পড়ে। পড়তে গিয়ে খুঁজে না পেলে মন খারাপ হবে। কোথায় গেল বইটা?

মনে পড়লো যে রোদেলা ট্রি হাউজে বসে বইটা পড়ছিল। তাহলে মনে হয় বইটা ওখানেই আছে।

আমি বাইরে বেরিয়ে ট্রি হাউজের দিকে এগুলাম। ট্রি হাউজের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছি, উঠবো কি উঠবো না! ওঠাটা কি ঠিক হবে? নাহ, উঠলে আর তেমন কি হবে? কতবার উঠেছি এখানে! কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, কেউ যেন বাঁধা দিচ্ছে আমাকে।

আমার জেদই জয়ী হল শেষ পর্যন্ত। এক ধাপ দুই ধাপ করে উঠতে লাগলাম। ঠিক তখনি হাতের মোবাইলটা বেজে উঠলো। অঝর ফোন দিয়েছে। আমি ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে অঝর বলল,

-
তুমি রেডি তো? আমি একটু পরই বের হবো।

আমি উপরে উঠতে উঠতেই উত্তর দিলাম,

-
হ্যাঁ, আমার সব কাজ শেষ। তুমি তাড়াতাড়ি চলে...

আমি আমার কথা শেষ করার আগেই আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলামব্যথাটা যেন এক নিমিষেই আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগলো। আমি মইটা ধরে রাখতে পারলাম না। প্রচণ্ড এক চিৎকার করে আমি নিচে পড়ে গেলাম। আমি শুনছি, মোবাইলের ওপাশ থেকে অঝর আমার নাম ধরে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না। চোখ বন্ধ হওয়ার আগে শুধু দেখেছিলাম, সবুজ ঘাসগুলো রক্তে ভিজে কালচে হয়ে যাচ্ছে.........

------------------------------------------------------------------------------------------------

চোখ খুলতেই আলোর ঝলকানি এসে আমার চোখ আবার বন্ধ করে দিল। এতো আলো! কোথায় আছি আমি? মরে গেলাম না তো! সাহস করে আবার ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। আলোর জন্য তাকিয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমি যে শুয়ে আছি, সেটা বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কোথায় শুয়ে আছি সেটা বুঝি নি। কেন শুয়ে আছি, সেটাও মনে পড়ছে না।

কষ্ট করে ঘাড় ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকিয়ে দেখি সোফায় আম্মু শুয়ে আছে। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে আমি হাসপাতালে শুয়ে আছি। হাপাতালের কথা মনে পড়তেই সেইদিনে কথা মনে পড়ে গেল। আমি ট্রি হাউজে উঠতে গিয়ে পা মচকে নিচে পড়ে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ করেই মনে হল, আমার বাবুটার কিছু হয় নি তো? আমার ধারা মামনিটা! ও কেমন আছে? ওর কিছু হলে আমি...
আমি কাতর কণ্ঠে আম্মুকে ডাকলাম। আমার চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়ছে। আম্মু আমার ডাক শুনতে পাচ্ছে না। আমি আবার ডাকলাম। আম্মু এবার চমকে উঠলো। আমাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ছুটে এলো আমার কাছে।

-
আমার মামনিটার জ্ঞান ফিরেছে! আমার মামনিটা একদম ভালো হয়ে যাবে এখন। আর কোন ভয় নেই। আম্মু আমাকে ধরে কাঁদতে লাগলো।

আমি আম্মুর দিকে ভয় মেশানো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-
আম্মু আমার বাবুটা কোথায়? আমার বাবুটা ভালো আছে? ওর কিছু হয় নি তো?

আম্মু কেঁদেই যাচ্ছে, আমার কথার কোন উত্তর দিচ্ছে না।

-
আম্মু প্লিজ বল আমার বাবুটা কোথায়? তোমার পায়ে ধরি প্লিজ বল।

এরই মধ্যে কেবিনের দরজা ঠেলে অঝর ভেতরে ঢুকল। আমি অঝরকে দেখে পাগলের মতো চিৎকার করে বললাম,

-
অঝর আমার ধারা কোথায়? আমার মামনিটা কোথায়?

অঝর আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

-
শ্রাবণ, প্লিজ এমন করো না। তুমি এখনো সুস্থ হও নি। এভাবে তোমার শরীর আরও খারাপ করবে। একটু শান্ত হও।

-
আমার ধারা কোথায় অঝর? তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন? আমার বাবুটার কিছু হয় নি, তাই না? প্লিজ বল যে আমার বাবুটার কিছু হয় নি...প্লিজ...

আমার চারপাশটা আবার যেন কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে...আমি আবার গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি......

আমাদের বাসাটা আজ খুব সুন্দর করে সাজিয়েছি। ড্রইংরুমের পুরোটা জুড়ে মোমবাতির আলো। সাজানোর উপলক্ষ হচ্ছে, জন্মদিন...আজ আমাদের ধারামামনির তিন বছর পূর্ণ হবে। ধারা একটা টেডি বিয়ার কোলে নিয়ে আমার পিছে পিছে ঘুরছে আর বলছে,
-
মামনি, আমি কখন কেক কাতবো?
-
দাদাভাই, রোদেলা খালামনি, নানা-নানু, সবাই আসুক, তারপর।
-
আমি খালামনিকে ফোন কলবো...তালাতালি আসতে বলবো...খালামনি আমাকে অনেত তকলেত দিবে।
রোদেলা ওকে কত চকলেট দিবে সেটা দেখাতে গিয়ে ওর হাত থেকে টেডিটা পরে গেল। আমি হাসতে হাসতে বললাম,
-
মামনি, তুমি দেখো তো তোমার বাবাই কি করে?

-
বাবাইইইইইইইইইইইই... কান ফাটানো চিৎকার করতে করতে ও অঝরের দিকে দৌড়ে গেল।

মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে। এই তো যেন সেদিন অঝর আমার কোলে তুলে দিয়েছিল একটা ফুটফুটে পুতুলকে। আজ সেই পুতুলটাই মস্ত এক পুতুল কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই পুতুলটাকে না পেলে কি আমার জীবন আবার রঙ্গিন হতো? হয়তো না।

যখন শুনেছিলাম আমার বাবুটা আর নেই তখন ইচ্ছে হচ্ছিলো নিজেকে শেষ করে ফেলি। আমার দোষেই তো এতো কিছু হল। এটাই শেষ ছিল না। আমার জন্য আরও কিছু খবর অপেক্ষা করছিলো। অঝরের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে আমি আর কোনদিন মা হতে পারবো না। আমি একটুও কাঁদি নি সেদিন। মনে হয়েছিলো, ভালোই হয়েছে। আমার পেট থেকে জন্মালে হয়তো বাচ্চাটা আমার মতই পোড়াকপালি হবে। তার গায়ের রঙটা অথবা তার নাকটা নিশ্চয়ই আমার মতই থ্যাবড়ানো হবে। খুব সহজভাবেই মেনে নিয়েছিলাম আমি।

সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবার আট মাস পর ধারাকে আমরা পালক নেই। ওকে কোলে নিয়েই আমি ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছু। আমার সারাদিন ওকে নিয়েই কাটে। গাল ভরে যখন আমকে মামনি বলে ডাকে, তখন বড্ড ভালো লাগে আমার।

আমাদের ট্রি হাউজটা আর নেই। আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম তখন অঝর সেটাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। ট্রি হাউজটার জন্য আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু অঝরকে কিছু বলি নি আমি। আমি জানি যে ঐ ট্রি হাউজটার ওপর ওর অনেক জেদ অনেক, ক্ষোভ জমে ছিল...

অঝরের আম্মু আমাকে এখনো মেনে নিতে পারেন নি। তার ভাষ্যমতে আমি হচ্ছি অপয়া। আমার স্পর্শে সবকিছু নাকি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে আব্বু প্রায়ই আসেন এখানে। ধারার সাথে তার বেশ খাতির। খাতির হবে না কেন? প্রতিবার একটা টেডি আর ক্যাডবেরির বড় একটা চকলেট নিয়ে আসতে একদমই ভুল হয় না তার...

-
শ্রাবণ, কি করছ তুমি? এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?

অঝরের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলামধারাকে কোলে নিয়ে কখন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারি নি।
-
কিছু না তো। দেখো, আমাদের মামনিটাকে একদম পরীর মতো লাগছে না?

-
হুম, পরীর মেয়ে তো পরীই হবে।

ধারা হঠাৎ করে বলল,

-
মামনি, তুমি কান্না কলো কেন?

ধারার কথা শুনে অঝর আমার দিকে ভালভাবে তাকাল আর বলল,

-
কান্না করা তোমার মামনির পুরনো অভ্যাস আম্মু।

অঝরের কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আমাকে হাসতে দেখে ধারা হাততালি দিয়ে বলল,

-
মামনি হাসে, মামনি হাসে...

আমার হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল।

মোমের আলোয় পুরো ঘরটায় এক অদ্ভুত আলো আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। আমি অঝরের গা ঘেঁষে বসে আছি আর ধারা আমার কোলে শুয়ে আছে। ঘরটার মতো আজ আমার জীবনটাও আলোয় আলোয় আলোকিত...

নিজের অজান্তেই গুনগুন করতে শুরু করলাম...

আমার মতন সুখী কে আছে
আয় সখী, আয় আমার কাছে
সুখী হৃদয়ের সুখের গান
শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ...

কোন অভিনয় নয়, কোন মিথ্যে নয়...সত্যি আজ আমি সুখী...আমার ছোট্ট এই পৃথিবী নিয়ে আমি ভীষণ সুখী............

________________________________________________________ সমাপ্তি ________________________________________________________


শেষ কথাঃ গল্পটিতে “অঝর” চরিত্রটি লিখেছেন- ক্ষণিকের আগুন্তুক এবং “শ্রাবণ” চরিত্রটি লিখেছেন- একজন লেখিকা। গল্পটি সম্পর্কে যেকোন মতামত জানাতে যোগাযোগ করতে পারেন এই ঠিকানায়-
 abegmoyvalobasha@gmail.com
                              
                           
অঝর-শ্রাবণ.jpg