শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩

অগোচর

রাত ৯টা বেজে ৩০ মিনিট। মোবাইলটা বেশ কিছুক্ষণ যাবত ভাইব্রেট করেই যাচ্ছে, জিসানের ফোন। উপায় না দেখে শেষে ফোন রিসিভ করতে হয় মোনাকে।
"প্লীজ জিসান আজ না, কাল থেকে আমার টার্ম ফাইনাল শুরু হচ্ছে। প্লীজ।"
"দেখ মোনা, এইসব পরীক্ষা তো আসবে যাবে, তাই বলে এতো বড় একটা সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না। ফরেন কান্ট্রি থেকে আসছে। তাছাড়া আমি কথা দিয়ে ফেলেছি, মানা করি কিভাবে?" 
মোনা আর কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয়।

নিন্ম মধ্যবিত্ত ঘরের মেধাবী মেয়ে মোনা। বাবা-মায়ের শখ রাখতেই উচ্চ শিক্ষার জন্য তাকে মফস্বল ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় যান্ত্রিকতায় মোড়া এই শহরে। প্রতি মাসে টিউশনি থেকে পাওয়া কিছু অর্থ আর বাবার দেওয়া অল্প কিছু টাকায় চলে যাচ্ছিলো দিনগুলো। সংসারে দু'টি মেয়ের পড়াশুনা আর যাবতীয় খরচ চালাতে হিমসিম খেতে হতো তার বাবা রহমত আলীকে। তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে দেনা-কর্য করে পাহাড় সমান দেনায় চাপা পড়ে যায় রহমত আলী বিগত আড়াই-তিন বছরে। তারপরও কোন আক্ষেপ নেই তার, মেয়ের একাউন্টিং পড়া শেষ হলেই সব দেনা কর্যের ভার থেকে মুক্তি পাবে রহমত আলী। মেয়ে চাকরী করে সব দেনা পরিশোধ করে দিবে। এই তো আর মাত্র দেড়টা বছর বাকী। অপেক্ষার দিন গুনতে থাকে রহমত আলী।

রাত ১০টা। আবারো মোবাইলটা ভাইব্রেট করছে। জিসানের ফোন।
"মোনা রেডি হয়েছিস? আমি কি নিয়ে আসবো বেটাকে?"
"নাহ, আমি এখনো পড়তেছি।"
"হারাম*দি, পড়া লেখা কইরা যে কি বা*টা করে ফেলবা তা জানা আছে । ভাল কইরা কইছিলাম দেখে কানে ঢুকে নাই? তাই না? আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আইতাছি। যদি আইজ কোন কিছু উল্টাপাল্টা হয়, তাহলে তোরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাইর কইরা দিমু। *লী।"
ফোন রেখে দেয় জিসান। জিসান নামের লোকটিকে অনেক ভয় পায় মোনা। তার হাতেই এখন মোনার পুরো পৃথিবীর বেঁচে থাকা নির্ভর করে।

হঠাৎ-ই একরাতে বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা উঠে রহমত আলীর। দিক্বিদিক না দেখে বুকে হাত দিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সাথে সাথে মোনার মা, হালিমা বেগম দৌড়ে এসে স্বামীকে আগলে ধরে। স্বামীকে নিয়ে মেয়ে মুন্নিকে সঙ্গে করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় হালিমা বেগম। পরদিন সকালে রহমত আলীর রিপোর্ট হাতে আসে। ব্রেন স্ট্রোকের ফলে দুই পা প্যারালাইসড হয়ে যায় রহমত আলীর। হাত আর মুখও খানিকটা বাঁকা হয়ে যায়। সদা হাস্যজ্বল রহমত আলীর হাসি হঠাৎ-ই বিলীন হয়ে যায়।

গত দু'মাস থেকে টিউশনি না থাকায় পুরো খরচটায় বাবার কাছ থেকে নিতে হয়েছিল মোনার। মোনা জানে তার কারনের বাবা ব্রেট স্ট্রোক করেছে। সেদিনের পর থেকে সে আর বাসায় যায় নি। শুধু মাস শেষে বাবার ওষুধের টাকা আর যাবতীয় খরচের টাকা বাবদ ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। ছোট বোন মুন্নি এস.এস.সি তে সব বিষয়ে এ+ পেয়েছে। অনেক বড় মানুষ হবে তার সে দিনকার ছোট্ট বোনটি। বোনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন মোনার। মুন্নি রোজ রোজ ফোন দিয়ে বাড়িতে যেতে বলে মোনাকে। কিন্তু পরীক্ষা আর টিউশনির অজুহাত দিয়ে পাড় পেয়ে যায় মোনা। প্যারালাইসড বাবা, দুঃখিনী মা, আর আদরের বোন মুন্নিই এখন মোনার পৃথিবী।

রাত ১০ টা বেজে ৫ মিনিট। বই গুঁটিয়ে মোনা বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় গোসলের উদ্দেশ্যে। আজ ফরেনার আসবে তার কাছে, একটু স্পেশাল ভাবেই তৈরি হতে হবে তাকে। বাথরুমে ঢুকে গায়ের জামা খুলে আয়নার সামনে দাড়ায় সে। গা থেকে জামা সরা মাত্রই ধবধবে সাদা শরীরে অসংখ্য কালো কালো দাগ প্রতীয়মান হয়। কোন কোনটা সিগেরেটের আগুনে ঝলসে যাওয়া বিদঘুটে দাগ আবার কোনটা জমাট বাঁধা রক্তের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন