বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১১

অহর-নিশি


-জান জানো বাবা না তোমাদের বাসায় আমাদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।
-সত্যি বলছো?
-হ্যাঁ তো জান। সত্যি সত্যি সত্যি।
মাহফুজের চোখ ছলছল করে উঠলো। পার্কের মধ্যেই অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে কয়েক ফোটা অশ্রু বিসর্জিত করলো মাহফুজ।

কলেজে ২য় বর্ষে থাকাকালীন সময়ে অনন্যার সাথে পরিচয় হয়। বন্ধুদের চোখে মোটামুটি সুন্দরি হলেও মাহফুজের নিকট স্বর্গীয় অপ্সরীর মতোই লাগতো অনন্যাকে। অবাক করা তার মুখের হাসি দেখে যেকোন ছেলের হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে বলে মাহফুজের ধারনা। অনন্যার বড় বড় দুটি চোখের ঢিপঢিপ চাহনিতে মাহফুজ অনেক বারই শহীদ হয়েছে। আবার সেই শহীদ শরীরে প্রান ফিরে এসেছে সেই ঢিপঢিপ চাহনী চোখওয়ালীর কণ্ঠে আদরের ডাকটা শুনে- "এই জান,কি হল তোমার!!! এভাবে কি কেউ কাউকে দেখে!!! মাহফুজ মুচকি হেসে বলে-

" কে বলে শারদশশী-সে মুখের তোলা,
পদনখে পড়ে আছে-তার কত গুলা।"

অশ্রুতে ভিজে যায় অনন্যার চোখ। মাহফুজ আলতো করে হাত বুলিয়ে চোখ মুছে দেয়।


মাহফুজের বাসা থেকে অনন্যার বাবার পাঠানো বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়। খুবই উচ্চ বংশের ছেলে মাহফুজ। তাই তথাকথিত রীতিনীতি এখনো পুরোপুরি দমিত হয়নি এই পরিবার থেকে। আর এর ফলেই এই প্রত্যাখ্যান পর্ব।

অনন্যা চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি। বাসা বাঁধবো দূর পর্বতের কোন এক দেশে। মেঘের ভেলায় করে ভেসে বেড়াবো দুজন। যখন বাতাসের নাউয়ে করে বৃষ্টির ফোটা দুজনকে ভিজিয়ে দিবে,তখন তোমায় জড়িয়ে ধরে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলবো,বউ তোমাকে না অনেক ভালবাসি। যখন চাঁদনী রাতে পুরো পর্বত শাঁ-শাঁ করবে,তখন দুজনে মুখরিত হয়ে জ্যোৎস্নাস্নানে ব্যাস্ত থাকবো। নদীর পাড়ে বসে অবাক হয়ে তুমি যখন ঢেউ আর আলোর খেলা দেখায় মগ্ন থাকবে,তখন তোমার কোলে মাথা রেখে অপলক দৃষ্টিতে তোমায় দেখবো।হঠাৎ ধমকা বাতাস এসে আমাদেরকে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে তার সাত রঙা রঙে। হবো আমরা সাত রঙে রাঙ্গা অচিন পাখি। বলো যাবে আমার সাথে?
অনন্যা আর বসে থাকতে পারল না। উঠে দারিয়েই হাঠা শুরু করলো। যাবার সময় বিড়বিড় করে বলে গেল-তোমাকে আজীবন ভালবেসে যাবো। বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।মাহফুজ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।বিকেল,সন্ধ্যা আর রাত গড়িয়ে কখন যে ভোর হয়ে গেল,টেরই পেলো না মাহফুজ। চোখের অবিরাম বর্ষা তাকে হয়তো আর কোনদিন ক্ষান্ত দিবে না। হয়তো তাকে নির্জনে চোখের এই অবুঝ ধারার সাথে খেলা খেলে যেতে হবে সারা জীবন।

কিছু দিন পর অনেকটা জেদ করে অনন্যার ফ্যামিলি এলাকার এক বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে অনন্যার। মাহফুজ অনেকবার অনন্যার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো কিন্তু অনন্যা শুনেনি। তার সাথে আর কখনই যোগাযোগ করেনি। মাহফুজ পাশের বাসায় ফোন করে ওকে দিতে বলত। ওপাশ থেকে অনন্যা বলতো মাহফুজের সাথে আর কখনো কথা বলতে চায় না।
ওদের বিয়ের দিনটা মাহফুজের দেখা হয়নি। আগের দিন তার ছোট বোনটার বাচ্চা হয়ার পরে খিচুনি হয়। এম্বুলেন্স আনা হয়। মাহফুজ দৌড়ে পানি কিনে আনতে যেয়ে চোখ আটকে গেলো। অনন্যার বাবা অনন্যার বিয়ের ফল কিনছে ।মাহফুজ কয়েক মুহূর্তের জন্য নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখ দিয়ে অবিরাম বর্ষণ হতে লাগলো,বোন একদিকে মারা যাচ্ছে , অন্যদিকে ওদের আয়োজন। বোনকে নিয়ে হসপিটালে এক সপ্তাহ ছিলো মাহফুজ। অবস্থা এত খারাপ ছিল যে ডাক্তার ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেছিল।ওর কাজিন সেখানে ছিল। ও বড় সব ডাক্তার দিয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করে। তিন দিন পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে বোনটা।মাহফুজ মেডিকেলের তিনতলার বারান্দায় বসে একের পর এক সিগারেট টানতো সারারাত আর একের পর এক মৃত মানুষ দেখতো। তারপরে যখন বাসায় চলে আসে,তখন ও আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারতো না। মনে হতো এই সিঁড়ি বেঁয়ে ছাদে যেয়ে অনন্যাকে দেখছে অথবা ঘরের মধ্যে ফিসফিস করে অনন্যা তাকে ডাকছে। এসব কিছুই অসহ্য হয়ে উঠে। কেন যেন নিজেকে মেরে ফেলর ইচ্ছে জন্মালো তার অবুঝ মনটায়। কিছুক্ষন পরই বাবা-মার কথা,পরিবারের সবার কথা ভেবে থেমে যেতো।

তিন মাস পর মাহফুজ দেশের গন্ডি পেড়িয়ে পাড়ি জমালো অচেনা এক দেশে- নিজের জীবন থেকে কালো একটি অধ্যায়ের ইতি টানতে। যেখানে কেউ তাকে জান বলে ডাকার থাকবে না। থাকবে না কোন সৃতি জড়ানো জায়গা।


প্রায় তিন বছর পর মাহফুজ এখনো তার সৃতির ভেলায় চড়ে অতীতের সপ্নমাখা দিনগুলোতে চলে যায়। হঠাৎ তার চোখ জলে ভিজে যায়। মাহফুজ যেন বিড়বিড় করে কি বলতে থাকে-"অনন্যা তোমাকে আমি আগেও ঘৃণা করতাম,এখনও করি,সারা জীবন করবো "

উৎসর্গ-আমার প্রিয় রিয়েল ডেমন ভাইয়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন